১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন সংক্ষিপ্ত বিবরণ আলোচনা করা হল উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ঔপনিবেশসমূহ হতে । এটি ইতিহাসের ভারত (১৯৪০ থেকে ১৯৪৬) এর অন্তর্গত ।
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ঔপনিবেশসমূহ হতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৯৪২ সংক্ষিপ্ত বিবরণ আলোচনা করা হল ।
১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৯৪২ আলোচনা প্রসঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূত্রপাত, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হল ।
প্রশ্ন:- ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। (২০২০)
ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ গণআন্দোলন হলো ৪২ এর বিপ্লব বা আগস্ট আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতে এত বড় গণ-আন্দোলন ইতিপূর্বে গড়ে ওঠেনি। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ এপ্রিল মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ পত্রিকায় ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের পরিকল্পনা পেশ করেন। এই বছর ১৪ ই জুলাই ওয়ার্ধা অধিবেশনে ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই আন্দোলনের নেতা হিসেবে গান্ধিজি ঘোষণা করেন, অবিলম্বে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও কংগ্রেস প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামবে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি
১৯৪২ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি তৈরি ছিল আগে থেকেই। যেমন –
(i) ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পটভূমিতে ভারতীয়দের সমর্থথন ও সহযোগিতার আশায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ ক্রিপস মিশন কিছু প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসে। কিন্তু এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি না থাকায় এই মিশন ব্যর্থ হয়। ফলে গান্ধীজীর মনে তীব্র ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, ‘ পূর্ণ স্বাধীনতা অপেক্ষা কম কোনো কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হবো না’।
(ii) জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা
১৯৪২ সালের প্রথম থেকেই জাপান একে একে সিঙ্গাপুর মালয় ও ব্রহ্মদেশ কে পদানত করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনাা দেখা দেয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতে, জাপানি আক্রমণের এই সম্ভাবনাই গান্ধীজিকে গণআন্দোলনেের দিকে ঠেলে দেয়।
(iii) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতিতে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ১৯৪০-৪১ সালে এই বৃদ্ধির হার প্রায় ১৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের ওপর কংগ্রেস ও সাধারণ মানুষের তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ পায়, যা গণআন্দোলনের চেহারা নেয়।
(iv) তীব্র দমননীতি
এই গণ আন্দোলন দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ওপর অকথ্য নির্যাতন ও সীমাহীন অত্যাচার শুরু করে। ফলে ভারতীয়রা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।
(v) স্বাধীনতার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা
ব্রিটিশ সরকারের স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে ঔদাসীন্য এবং সাংবিধানিক সংস্কারের অনাগ্রহ ভারতীয়় নেতৃবৃন্দকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। ভারতবাসী যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতালাভকে নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, ” ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধি যতটা নেতা, ততটাই জনগণের ইচ্ছার দাস।”
(vi) পোড়ামাটির নীতি
জাপানি আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পূর্ব ভারতে পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে। ফলে এই এলাকায় প্রচুর খাদ্যশস্য ধ্বংস হয় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তাদের এই নীতিও ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
(vii) গান্ধীজীর অনমনীয় মনোভাব
অসহযোগ, আইন অমান্য প্রভৃতি আন্দোলন সত্বেও ব্রিটিশ সরকারের উদাসীনতা এবং ভারতের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্রিটিশদের সদিচ্ছার অভাব গান্ধীজিকে যারপরনাই ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তার এই অনমনীয় ক্ষোভ ভারতছাড়ো আন্দোলনের মতো একটি গণআন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল। জহরলাল নেহরু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ” গান্ধীজিকে ইতিপূর্বে আর কখনো এতটা ব্রিটিশবিরোধী হতে দেখা যায়নি।”
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূত্রপাত
এই পটভূমিতে ৭ ই আগস্ট বোম্বাইয়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভা বসে। ৮ ই আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। শুরু হয় ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ বৃহত্তর আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ঘোষিত হয় “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।”
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
তীব্র গতিতে চলা এই আন্দোলন কিছু দিনের মধ্যেই তার গতি হারিয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পিছনে কারণ গুলি হল –
(i) নেতৃত্বের অভাব
ভারত ছাড়াে আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে গান্ধিজির নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গান্ধিজি-সহ কংগ্রেসের সব শীর্ষনেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গান্ধিজির অবর্তমানে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতাে শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
(ii) বিভিন্ন দলের বিরােধিতা
ভারতের কমিউনিস্ট দল পরােক্ষভাবে ভারত ছাড়াে আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিল। মুসলিম লিগ, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গােষ্ঠী, হিন্দু মহাসভা, এই আন্দোলনে সহযােগিতা করেনি। ফলস্বরূপ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
(iii) অসময়ে সূচনা
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গান্ধি অনুগামীরা তখন তা করেননি। সেই আন্দোলন গান্ধিজি শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে ইংল্যান্ড-সহ মিত্রপক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই বিলম্ব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।
(iv) প্রাকৃতিক দুর্যোগ
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র মেদিনীপুরে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। তাছাড়া ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
(v) মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা
মুসলিম লীগ ও মুসলিম সম্প্রদায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখায় এই আন্দোলন প্রকৃত গণ-আন্দোলনের হয়ে উঠতে পারে নি। ফলে আন্দোলনের ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব
ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্বকে একেবারেই অস্বীকার করা যায় না। এই আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(i) সর্বস্তরের মানুষের যোগদান
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ সরকারের বিরোধিতায় গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়।
(ii) কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি
কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়। এই প্রসঙ্গে সমাজবাদী কংগ্রেস নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘Towards Struggle’ গ্রন্থে লেখেন, “The Congress alone is the country’s salvation.”
(iii) স্বাধীনতার অজেয় সংকল্প
১৯৪২-এর ভারত ছাড়াে আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর ঘনীভূত ক্ষোভ ও তা থেকে মুক্তির জন্য অজেয় সংকল্প এই বিদ্রোহে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
(iv) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার
মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যােগ না দিলেও ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মুসলিম এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশ নেয়। তাছাড়া আন্দোলন চলাকালে কোথাও কোনাে সাম্প্রদায়িক বিরােধ বাধেনি। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছিল এই আন্দোলনের এক বিশাল সম্পদ।
(v) জাতীয় বিপ্লব
৪২-এর আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন- “নেতা সংগঠন নেই, উদ্যোগ আয়ােজন কিছু নেই, কোনাে মন্ত্রবল নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার আর কোনাে পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল—এ দৃশ্য বাস্তবিকই বিস্ময়ের।” অরুণ চন্দ্র ভূঁইয়া তাঁর ‘ The Quit India Movement ‘ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই আন্দোলনের ফলে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যবােধ গড়ে ওঠে।
(vi) স্বাধীনতা ভিত্তি প্রস্তুতি
৪২-এর আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা — এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। ড. অম্বাপ্রসাদ বলেন যে, “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে।”
(vii) গণ আন্দোলন হিসেবে
এই আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষক-সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ আন্দোলনের রূপদান করে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মন্ত্র মুখর’ উপন্যাসে আগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়াে আন্দোলনের গণজাগরণের চিত্র ধরা পড়ে।
মূল্যায়ন :- ইউরোপের বুকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন সারা ভারত জুড়ে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের তীব্রতাকে ভয় পেয়েই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল যে , ভারতবাসীকে এবার স্বাধীনতা প্রদান করতেই হবে।