চতুর্থ অধ্যায় বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর।
বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা
প্রশ্ন:- বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর।
ভূমিকা:- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বাংলা তথা বাংলাদেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সংগঠিত নবজাগরণ বা রেনেসাঁস এর অন্যতম প্রধান পীঠস্থান ছিল বাংলা। রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ ছিলেন সেই নবজাগরণের ধারক ও বাহক।
নবজাগরণ
নবজাগরণের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘রেনেসাঁস’ হলো একটি ফরাসি শব্দ। ষোড়শ সপ্তদশ শতকে ইউরোপে শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সূচিত হয় তাই ছিল নবজাগরণ। পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সূত্রে উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছিল তাকে অনেকেই নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন।
নবজাগরণের স্রষ্টা
ভারত তথা বাংলার নবজাগরণের স্রষ্টা ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বাদী প্রবক্তাগণ। সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যে বিশ্বাসী মনীষীরা যেমনভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন ঠিক তেমনভাবে পাশ্চাত্যবাদী মনীষীরাও উপলব্ধি করেছিলেন প্রাচ্যের সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। উভয় গোষ্ঠী বুঝেছিলেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন দ্বারাই ভারতীয়রা সু-সভ্য হয়ে উঠবে।
নবজাগরণের প্রকৃতি
উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। যেমন –
- (1) রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশব চন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ উনিশ শতকের বাংলায় মানসিক ও সামাজিক স্ফুরণকে নবজাগরণ বলেই আখ্যা দিয়েছেন।
- (2) ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তাঁর ‘হিস্টি অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে নবজাগরণের পীঠস্থান বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে বাংলার নবজাগরণ ছিল অনেক বেশি গভীর এবং বৈপ্লবিক।
- (3) অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনের বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়, যা নবজাগরণ ঘটায়।
বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয়
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে অনেকেই স্বীকার করেন না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন কথা বলেছেন। যেমন –
(i) তথাকথিত নবজাগরণ
প্রখ্যাত পন্ডিত অশোক মিত্র বাংলার নবজাগরণকে ‘তথাকথিত’ নবজাগরণ বলেছেন। তাঁর মতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে উদ্ভূত নতুন জমিদার শ্রেণী তাদের আয়ের একটা বিরাট অংশ তারা কলকাতার সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেন। ফলে সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো যোগ ছিল না।
(ii) ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয়
গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে অনেক ভিন্ন ও বিপরীতমুখী।
(iii) ঐতিহাসিক প্রতারণা
ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্ৰন্থে বলেছেন উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার। তিনি একে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন।
নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন —
- (i) উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। সাধারন মানুষের একটা বড় অংশ এই নবজাগরণে শরিক হতে পারে নি।
- (ii) ইতালির ফ্লোরেন্স নগরী ইউরোপের নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার ক্ষেত্রে কলকাতার তা করতে পারেনি। ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না।
- (iii) বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত বর্ণ হিন্দুদের। মুসলিম সমাজ এই নবজাগরণের বাইরে ছিল।
- (iv) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তারা বাংলার সমাজকাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতে পারে নি।
নবজাগরণের গুরুত্ব
উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে, ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভারতীয়দের কাছে এর আগে এই ধারণা স্পষ্ট ছিল না। নবজাগরণের ফলেই ভারতীয় সামাজ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পদার্পণ করে।