বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: হরপ্পা সভ্যতা থেকে ১০ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে ঋকবৈদিক সংস্কৃতির তুলনা করা হল।
হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে ঋকবৈদিক সংস্কৃতির তুলনা
প্রশ্ন:- হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে ঋকবৈদিক সংস্কৃতির তুলনা কর।
একদিকে বৃহৎ প্রাসাদ, দুর্গ এবং অন্যদিকে ছোটো ছোটো দুই কামরার ঘর সিন্ধু সভ্যতায় ধনী-দরিদ্রের শ্রেণি বৈষম্যের প্রমাণ দেয়। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল বৈদিক সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। এখনও কোনো কোনো পণ্ডিতের ধারণা, হরপ্পা সংস্কৃতি (সিন্ধু সভ্যতা) ও বৈদিক সংস্কৃতি অভিন্ন। কিন্তু অন্য বহু পণ্ডিতের মতে, উভয় সংস্কৃতি বা সভ্যতাকে অভিন্ন ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ সময়গত ও সংস্কৃতিগত বহু প্রভেদ এদের মধ্যে বর্তমান।
সাদৃশ্য
সিন্ধু-সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে অনেকগুলি ক্ষেত্রেই আপাত সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন – সিন্ধুবাসী ও বৈদিক আর্যদের খাদ্য ও পোশাক ছিল প্রায় এক রকম। গম, যব, ছাতু প্রভৃতি উভয় যুগেই খাদ্যরূপে গৃহীত হত। সিন্ধু সভ্যতার নারীদের মতো বৈদিকযুগের নারীরাও মণিমুক্তাখচিত অলঙ্কার পরিধান করত। উভয় আমলেই কেশবিন্যাসের রীতি ছিল একই রকম।
উভয় সভ্যতার ক্ষেত্রেই বয়নশিল্পে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধুবাসী ও বৈদিক আর্য উভয় সম্প্রদায়ই তুলার চাষ করত এবং তুলা থেকে সুতা তৈরি করে বস্ত্র বয়ন করত। পরিশেষে বলা যায়, নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষার দ্বারা সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে আর্যদের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, ঐ অঞ্চলে আর্যরাও ছিল।
বৈসাদৃশ্য
উল্লিখিত সাদৃশ্যগুলি থাকলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে উভয় সংস্কৃতির মধ্যে বহু বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
(১) নগর বনাম গ্রামীণ সভ্যতা
সিন্ধু-সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োয় আবিষ্কৃত দ্বিতল পাকাবাড়ি, প্রশস্ত রাজপথ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, পরিকল্পিত স্নানাগার ও খাদ্যভাণ্ডার প্রভৃতি উন্নত নাগরিক জীবনের পরিচয় বহন করে। পক্ষান্তরে পাকাবাড়ির পরিবর্তে মাটির দেওয়ালযুক্ত বাড়িই ছিল আর্যদের প্রধান বাসস্থান। আর. এস. শর্মার ভাষায় “At best Rigvedic Aryans lived in fortified places protected by mud-walls at the times of floods, and they cannot be regarded as town in Harappan Sense.”
(২) জীবিকা নির্বাহে তফাত
পশুপালন ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা। স্থানান্তরে ভ্রমণ করে এবং পশুপালন করে তারা জীবননির্বাহ করত। কিন্তু সিন্ধুবাসীরা স্থায়ীভাবে বসবাস করত এবং ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ ও বাণিজ্য করে নিজেদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল।
(৩) লোহার প্রচলন
সিন্ধু-সভ্যতায় লোহার প্রচলন ছিল না। অর্থাৎ লোহা তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু বৈদিকযুগে লোহার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু জিনিস আর্যরা লোহা দ্বারা নির্মাণ করত। লোহার মতো ঘোড়াও সিন্ধু অধিবাসীদের কাছে অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু আর্যদের কাছে ঘোড়া ছিল অতি প্রয়োজনীয় একটি জন্তু।
(৪) ধর্মগত প্রভেদ
উভয় সভ্যতার মধ্যে ধর্ম-ভাবনাগত অনেক প্রভেদ ছিল। সিন্ধু-সভ্যতায় মাতৃপূজার ও লিঙ্গপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু আর্যদের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল না, এবং তারা লিঙ্গপূজাকে ঘৃণার চোখে দেখত। হরপ্পা সংস্কৃতির তুলনায় ঋকবেদের যুগে ধর্মাচরণ ছিল অনেক বেশি ব্যয়বহুল। মার্শালের মতে, সিন্ধুবাসীরা ষাঁড়ের পুজা করত, কিন্তু আর্যরা গাভীর পূজা করত। সিন্ধু-সভ্যতায় অগ্নিপূজার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, কিন্তু আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন ছিল।
সামাজিক প্রভেদ
সামাজিক রীতি-নীতি ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও উভয় সভ্যতার মধ্যে প্রভেদ ছিল। সিন্ধু-সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃকেন্দ্রিক, কিন্তু বৈদিক সমাজব্যবস্থা ছিল পিতৃতান্ত্রিক। হরপ্পা সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলিতে আবিষ্কৃত সমাধিস্থান থেকে বোঝা যায়, ঐ যুগে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা হত। কিন্তু আর্যরা মৃতদেহকে আগুনে ভস্মীভূত করত। পার্থিব জীবনকে সিন্ধুবাসী বেশি গুরুত্ব দিত। কিন্তু বৈদিক সভ্যতা ছিল মূলত আধাত্মিক। সিন্ধুবাসীরা লিখন পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। কিন্তু আর্যরা জ্ঞানচর্চায় অগ্রণী হলেও তাদের মধ্যে লিখন-পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। সিন্ধুবাসীরা ছিল শান্তিকামী, কিন্তু আর্যরা ছিল যুদ্ধপ্রিয়।
খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য
উভয় আমলেই খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও কিছু বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধুসভ্যতার যুগে মাছ ছিল অন্যতম প্রধান খাদ্য। তাছাড়া, ঐ যুগে ছোটো জীবজন্তু, যেমন – শুকর, ছাগল প্রভৃতির মাংস ভক্ষণ করা হত। কিন্তু আর্যরা মাছ ভক্ষণ করত না, তারা গোরু, ঘোড়া প্রভৃতির মাংস ভক্ষণ করত।
মৃৎশিল্পের প্রভেদ
সিন্ধুবাসী ও আর্যদের নির্মিত মৃৎপাত্রের মধ্যেও পার্থক্য ছিল। সিন্ধু-উপত্যকায় আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রগুলির রং ছিল কালচে লাল। কিন্তু আর্যদের নির্মিত মৃৎপাত্রগুলির রং ছিল ধূসর। রং ব্যবহারের এই পার্থক্য দুটি সভ্যতার আলাদা অস্তিত্বের নির্দেশ করে।
উপরিলিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সিন্ধু-সভ্যতা বা হরপ্পা সংস্কৃতি ও আর্য-সভ্যতা অভিন্ন ছিল না। একথা পরিষ্কার যে, হরপ্পার তুলনায় আর্য-সভ্যতা ছিল পশ্চাদপদ। তাই অনেকে একে বর্বর সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন। গর্ডন চাইল্ডের মতে, আর্যরা যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা উন্নত সভ্যতাকে ধ্বংস করে তাদের বর্বর সত্যতা চাপিয়ে দিয়েছে। ড. অতুল সুরও বলেছেন যে, আর্যরা ধ্বংস করতে পারেনি কেবল ঐতিহ্যসম্পন্ন ভারতীয় সভ্যতাকে। কারণ, সিন্ধু-সভ্যতা-সংস্কৃতিই পরবর্তী হিন্দু-সভ্যতার উপাদান রূপে কাজ করেছে।