বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস প্রথম অধ্যায়: প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাসের উপাদান থেকে ১০ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – ভারতের বাইরে প্রাপ্ত ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান পাওয়া গেছে এমন দুটি শিলালিপির নাম লেখ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব কতখানি তা আলোচনা করা হল।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব
প্রশ্ন:- ভারতের বাইরে প্রাপ্ত ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান পাওয়া গেছে এমন দুটি শিলালিপির নাম লেখ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব কতখানি?
উত্তর:- ভারতের বাইরে প্রাপ্ত ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান পাওয়া গেছে ‘বোঘাজকোয়’ শিলালিপি এবং ‘নকসিরুস্তম’ শিলালিপি দুটিতে। এশিয়া মাইনরে পাওয়া ‘বোঘাজকোয়’ শিলালিপি থেকে জানতে পারা গেছে, ভারতে প্রবেশ করার পূর্ব দিনগুলিতে আর্যদের বিস্তৃতি সম্পর্কে। ‘নকসিরুস্তম’ শিলালিপি থেকে প্রাচীন ভারতের সঙ্গে ইরানের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ে জানা যায়।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব সর্বাধিক। ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে খননকার্য চালিয়ে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ভারত-সভ্যতার বহু অজ্ঞাত তথ্য আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছে। যেমন, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে খননকার্যের ফলেই আমরা জানতে পেরেছি যে, খ্রিস্টের জন্মের বহু পূর্বেও ভারতে উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এই জন্যই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে ‘প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের প্রধান নোঙর’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে প্রাচীন লিপি, মুদ্রা এবং সৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভ – এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে প্রথমেই লিপির নাম করা যায়। প্রাচীন লিপির গুরুত্ব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের মধ্যে লিপি বা লেখাগুলিকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। কারণ, তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে এদের অবদান অমূল্য প্রাচীন ভারতীয় শাসকেরা পবর্তগাত্র, প্রস্তরখণ্ড, তাম্রপট ও স্তম্ভে বা মন্দিরগাত্রে বিভিন্ন লিপি উৎকীর্ণ করাতেন। এই সব লিপির পাঠোদ্ধার করে প্রাচীন যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বহু তথ্য পাওয়া গেছে। লিপিতে প্রাপ্ত সন, তারিখ থেকে বিভিন্ন রাজবংশের সময়কাল, লিপিগুলির অবস্থান থেকে বিভিন্ন রাজ্যের সীমানা এবং খোদিত বিবরণ থেকে রাজবংশের নাম ও রাজাদের কৃতিত্ব প্রভৃতি বহু তথ্য জানা সম্ভব হয়।
মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত লিপিই সর্বাধিক প্রাচীন। তবে এগুলির পাঠোদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি। মৌর্য সম্রাট অশোকের লিপিই প্রাচীন ভারতের লিপিযুগের সূচনা করেছে। পরবর্তীকালে খোদিত লিপিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কনিষ্কের মথুরা ও পেশোয়ার লিপি, সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ বিরচিত এলাহাবাদ লিপি (প্রশস্তি), সাতবাহন রাজাদের নাসিক ও নানঘাট লিপি, খারবেলের হাতিগুম্ফা লিপি, রুদ্রদামনের জুনাগড় লিপি প্রভৃতি। কয়েকটি বিদেশী লিপি থেকেও ভারতের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া গেছে। যেমন বোঘাজকই লিপি থেকে আর্যদের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা গেছে এবং নকসিরুস্তম লিপি থেকে পারস্যের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের সূত্র পাওয়া গেছে।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম উপাদান হল মুদ্রা। বর্তমানের মতো প্রাচীনকালে কাগজি মুদ্রা ছিল না, কিংবা অর্থ সঞ্চয়ের জন্য ব্যাঙ্কও ছিল না। তখনকার মুদ্রা ছিল পোড়ামাটির এবং ধাতুর। মানুষ সঞ্চয়ের জন্য মুদ্রা নির্দিষ্ট পাত্রে জমিয়ে রাখত। পরবর্তীকালে খননকার্যের ফলে ঐসব মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাবিশারদগণ ঐসব মুদ্রার লিপি, ছবি বা আকৃতি বিশ্লেষণ করে নানা ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কার করেছেন। প্রাচীন ভারতের এমন বহু শাসকের অস্তিত্ব ছিল, যাদের সম্পর্কে শুধুমাত্র মুদ্রা থেকেই তথ্য পাওয়া সম্ভব।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার বহুমুখী অবদান স্বীকৃত। মুদ্রায় খোদিত সন-তারিখ থেকে নির্দিষ্ট রাজার শাসনকাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তেমনি কোনো বংশের শাসকদের বা বিভিন্ন বংশের ক্রমপরম্পরা সম্পর্কে মুদ্রার সন-তারিখ আমাদের আভাস দেয়। মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান থেকে কোনো রাজা বা রাজবংশের সাম্রাজ্যসীমা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বা বাণিজ্য-সম্পর্ক বিষয়ে ধারণা পেতে সাহায্য করে। ভারতে প্রাপ্ত বহির্দেশীয় মুদ্রা বা বহির্ভারতে প্রাপ্ত এদেশীয় মুদ্রা থেকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞানলাভ করা যায়।
কোনো রাজা বা রাজবংশের অর্থনৈতিক অবস্থার ছবি মুদ্রা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু বা ধাতুর পরিমাণ ঐ যুগের আর্থিক সচ্ছলতা বা দৈন্যতা সম্পর্কে আভাস দেয়। গুপ্তযুগে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় পরবর্তী গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেশি ছিল। এ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, পরবর্তী গুপ্তযুগের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছিল। আবার গুপ্তযুগের পরবর্তীকালে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন কমে যাওয়ায় বোঝা যায় যে, তখন ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা এসেছিল।
মুদ্রায় খোদিত ছবি থেকে কোনো রাজা বা রাজবংশের সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার ধারণা পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে মনে করা যেতে পারে যে, তিনি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। একইভাবে মুদ্রার ছবির আকৃতি বহির্দেশের প্রভাব সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মুদ্রায় খোদিত দেব-দেবীর মূর্তি সমসাময়িক ধর্মভাবনা ও দেব-দেবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে চিত্র তুলে ধরে।
সৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ ও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকেও প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায়। বিশেষ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কর্মের নিদর্শন হিসেবে এদের অবদান অনস্বীকার্য। মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ থেকে ঐ যুগের উন্নত সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের তথ্য সমাজজীবনের সুদীর্ঘ বিবরণ রচনা করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া পাটলিপুত্র, সারনাথ, তক্ষশিলা প্রভৃতি নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে সমসাময়িক জনসাধারণের ধর্মভাবনা, জীবনযাত্রা ও শিল্পকর্ম সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরের নির্মাণশৈলী বা মন্দির গাত্রে খোদিত চিত্রাবলী থেকেও প্রাচীনকালে ধর্মভাবনা বা স্থাপত্যকর্মের ইতিহাস জানা যায়। আঙ্কোরভাট ও বরবুদুরের মন্দিরগুলি থেকে যথাক্রমে কম্বোজ ও জাভার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ চাক্ষুষ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনায় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ রেমণ্ড অলচিন-এর মতে, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং লিখিত উপাদানের মিলিত সহযোগিতায় প্রাচীন ইতিহাসের সম্পূর্ণ ও সঠিক তথ্য উদঘাটন সম্ভব’।