উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায়: ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ হতে কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০) কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০) কারণ ও ফলাফল
৮. কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০) কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। (২০২০)
সূচনা :- ১৯৪৫ সালে কোরিয়াবাসীর অনুমতি ছাড়াই কোরিয়াকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয় কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধ।
সংকটের সূত্রপাত
কোরিয়া ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর সূচনা পর্যন্ত জাপান -এর কর্তৃত্বাধীন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন সেনা ও সােভিয়েত লালফৌজ জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করে। অবশেষে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ার উত্তরাংশে রাশিয়ার ও দক্ষিণাংশে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমস্যা সমাধানে কমিশন গঠন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মস্কোয় রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হয়ে এক যুগ্ম কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন কোরিয়ার অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করবে বলে ঘােষণা করা হয়। কিন্তু আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তখন বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করলে সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ সভা ৯ টি সদস্যরাষ্ট্র নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Commission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই কমিশনের ওপর কোরিয়া থেকে বিদেশি সেনা অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকার গঠন
রাষ্ট্রসংঘের অস্থায়ী কমিশনের সদস্যদের রাশিয়া উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে নিজ তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি নির্বাচন আয়ােজন করে ১৫ আগস্ট প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া (Republic of Korea) নামে সেখানে মার্কিন-প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সিওল হয় এর রাজধানী। এই সরকারকেই রাষ্ট্রসংঘ সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি জানায় (১২ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ খ্রি.)। পরের বছর ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রও প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া তথা দক্ষিণ কোরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। মার্কিন মদতপুষ্ট সিংম্যান রি ছিলেন এই সরকারের প্রধান।
উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন
দক্ষিণ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সুদূরপ্রাচ্যে যখন একটি মার্কিন ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে, তখন কোরিয়া সমস্যাকে আরও জটিল করে তােলেন উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সুঙ। সােভিয়েত মদতে তিনি সেখানে গণতান্ত্রিক কোরিয়া (Peoples’ Democratic Republic of Korea) নামে একটি সরকার গঠন করেন। পানমুনজম হয় এর রাজধানী। এই সরকারের সেনাবাহিনী কোনাে পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবেশ করলে দু-পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই।
আন্তর্জাতিক সেনা প্রেরণ
নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে এবং কোরিয়ায় রাষ্ট্রসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়।
চিনের অংশগ্রহণ
রাষ্ট্রসংঘ প্রেরিত বাহিনীর প্রধান জে. ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শত্রুসেনা বিতাড়িত করার পর ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ায় ইয়ালু নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে বােমাবর্ষণ করলে চিন তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরপরই চিন কোরিয়া যুদ্ধে যােগদান করে এবং অতি দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নেয় (৪ জানুয়ারি, ১৯৫১ খ্রি.)।
যুদ্ধের অবসান
শেষপর্যন্ত ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পানমুনজমে উভয়পক্ষের যুদ্ধবিরতি ঘটে। পূর্বের মতাে ৩৮° অক্ষরেখা ধরেই দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।
কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল
আপাত দৃষ্টিতে কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি নিরর্থক যুদ্ধ। অবশ্য বাস্তব ক্ষেত্রে এই যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
(১) বিভাজন স্বীকার
বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সংযুক্তি তাে দূরের কথা, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয়।
(২) মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি
এই যুদ্ধে দুই কোরিয়ারই প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। মার্কিনি, কোরীয়, চিনা সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
(৩) আমেরিকার সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রস্তুতি
যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের পর তার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তােলার প্রস্তুতি নেয়।
(৪) ঠান্ডা লড়াইয়ের বিস্তার
এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।
(৫) জাতিপুঞ্জের মর্যাদা হ্রাস
মার্কিন মদতে জাতিপুঞ্জের বাহিনী উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করে। ফলে জাতিপুঞ্জের নিরপেক্ষ চরিত্র ও মর্যাদা নষ্ট হয়।
(৬) রুশ-চীন মৈত্রী
এই যুদ্ধের দ্বারা মার্কিন-চীন বিরোধ বৃদ্ধি পায় এবং রুশ-চীন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।
উপসংহার :- কোরিয়ার যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল অনাবশ্যক ও নিষ্ফল, কেননা দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফল ছিল শূন্য।