ভারতের সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়: মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলন হতে ভারতের সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান পর্যালোচনা করা হল ।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান

প্রশ্ন:- ভারতের সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান পর্যালোচনা কর।

ভূমিকা:- ইতালির রেনেসাঁস-এর ক্ষেত্রে পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও যেমন ছিলেন তেমনি ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যার জন্য তাকেই ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ভারতপথিক এবং অধ্যাপক দিলিপ কুমার বিশ্বাস তাঁকে বিশ্বপথিক বলে অভিহিত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে জরাজীর্ণ ভারতীয় সমাজের মুক্তি। ভারতীয় জনজীবনে রামমোহনের অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –

রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মসংস্কার

ভারতে হিন্দু সমাজের আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র, কুসংস্কার প্রভৃতি রামমোহনকে ব্যথিত করেছিল। তিনি ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –

(ক) বেদান্তের আদর্শ

বেদান্তের আদর্শের দ্বারা তিনি যেমন ঔপনিষদিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন তেমনি খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষাও করেন।

(খ) একেশ্বরবাদী আদর্শ

তিনি বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি গ্ৰন্থের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, একেশ্বরবাদই সকল ধর্মের মূল কথা। তাঁর মতে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

(গ) মতাদর্শের প্রচার

একেশ্বরবাদের সমর্থনে ফারসি ভাষায় ‘তুহাফৎ উল – মুয়াহিদ্দিন’ বা একেশ্বরবাদীদের প্রতি’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা ভাষায় বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন এবং ঈশ, কেন, বাট, মান্ডূক্য ও মণ্ডূক এই পাঁচটি প্রধান উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করে তাঁর মতবাদ প্রচারে উদ্যোগী হন।

(ঘ) আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা

নিজের ধর্মভাবনা সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা করেন। নানা ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে এই সভায় আলোচনা হত।

(ঙ) ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা

একেশ্বরবাদী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে উপাসনায় যোগ দিতে পারতো। এটি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নাম ধারণ করে।

রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার

সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন নিরলস সংগ্রামী। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন, সামাজের কুসংস্কার দূর না হলে জাতি গঠন হবে না। নির্যাতিত নারী জাতির মুক্তির কথা তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন। সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ গুলি হল –

(ক) কুপ্রথার বিরোধিতা

তিনি হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্য প্রথা, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।

(খ) সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা

নৃশংস সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন।

(গ) অন্যান্য সামাজিক কাজ

তিনি নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবা বিবাহের প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। কৌলীন্য প্রথা ও গঙ্গায় সন্তান বিসর্জনের বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছিলেন। এছাড়াও হিন্দু সমাজের জাত-পাত ব্যবস্থার অযৌক্তিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষাসংস্কার

রামমোহন মনে করতেন যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই নতুন ভারত গড়ে উঠবে। এই উদ্দেশ্য তিনি একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –

(ক) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজ ব্যয়ে অ্যাংলো হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয় ১৮২৬ সালে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজে পাশ্চাত্য সমাজ, বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। এমনকি তিনি কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

(খ) আমহার্স্টকে চিঠি

তিনি লর্ড আর্মহাস্টকে একটি চিঠি লিখে ভারতবাসীর জন্য পাশ্চাত্য গণিত, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, পাশ্চাত্য দর্শন এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রভৃতির দাবী জানান। তাঁর এই পত্রটি নবজাগরণের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

রাজা রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক সংস্কার

রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে রামমোহনের অবদান অনস্বীকার্য। উচ্চহারে খাজনা আদায়, জমিদারদের অত্যাচার প্রভৃতি সামাজিক উৎপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং প্রতিবাদ জানান। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, জুরির সাহায্যে বিচার, উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দাবি জানিয়ে ছিলেন তিনি।

রাজা রামমোহন রায়ের অন্যান্য সংস্কার

রামমোহন আরও বেশ কিছু সংস্কারে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। যেমন —

(ক) বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশ

বিভিন্ন সংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলা পুস্তিকা ও উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। এর ফলে বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এজন্য তাঁকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক বলা হয়।

(খ) সাংবাদিকতা

তিনি বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী‘ (১৮২১ খ্রিঃ) এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আকবর’ (১৮২২ খ্রিঃ) প্রকাশ করেন। তাছাড়া সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্যোগ নিলে তিনি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাই ঐতিহাসিক ড. বিপাণ চন্দ্র তাঁকে ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্ৰদূত’ বলে অভিহিত করেছেন।

মূল্যায়ণ :- সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আধুনিক ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতায় তার অবদান অনস্বীকার্য বলে মনে করা হয়। তাঁকে নিঃসন্দেহে নব ভারতের অগ্ৰদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “রামমোহন রায় ভারত ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা করেন।“

Leave a Comment