ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাবগুলি কি ছিল? ভারতীয়রা কেন ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল?

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশ সমূহ হতে ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাব গুলি কি ছিল? ভারতীয়রা কেন এগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল তা আলোচনা করা হল।

ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাবগুলি কি ছিল? ভারতীয়রা কেন ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল?

প্রশ্ন:- ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাব গুলি কি ছিল? ভারতীয়রা কেন এগুলি প্রত্যাখ্যান করে?

উত্তর:- ভূমিকা:- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির সাঁড়াশি আক্রমণের চাপে মিত্রশক্তির দেশগুলি নাজেহাল হয়ে পড়ে। ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে তারা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ভারতেও জাপানের আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস কে ভারতে পাঠান। তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছোন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে ক্রিপসের এই ভারত-আগমন ‘ক্রিপস দৌত্য’ বা ‘ক্রিপস মিশন’ নামে পরিচিত।

ক্রিপসের প্রস্তাব

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার পর তাদের কাছে ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব ‘ক্রিপস প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে বলা হয় যে,

  • (ক) যুদ্ধের পর ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন’-এর মর্যাদা দেওয়া হবে।
  • (খ) যুদ্ধের পর ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে।
  • (গ) সংবিধান সভার সদস্যরা প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।
  • (ঘ) এই সংবিধান সভা ভারতের নতুন সংবিধান রচনা করবে।
  • (ঙ) ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজের সংবিধান রচনা করবে।
  • (চ) সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ওপর ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে।
  • (ছ) ভারতীয়দের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।
  • (জ) বড়োলাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে আপাতত বেশি সংখ্যক ভারতীয় সদস্য নেওয়া হবে।

ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করে নি। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কেবলমাত্র মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘রাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ ক্রিপস প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। ক্রিপস প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের বিরোধিতার একাধিক কারণ ছিল। যেমন –

(ক) কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া

দেশবিভাগের সম্ভাবনাকে প্রশয় দেওয়ায় ক্রিপস প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।

(খ) মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া

প্রদেশগুলিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়ায় লিগ খুশি হলেও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের, অর্থাৎ পাকিস্তান দাবি স্বীকৃত না হওয়ায় লিগ ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

(গ) শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ও ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারে নি। তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে।

(ঘ) হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, ক্রিপস প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

(ঙ) হিন্দু মহাসভার প্রতিক্রিয়া

হিন্দু মহাসভা আশঙ্কা করেছিল যে ক্রিপস প্রস্তাবের ফলে ভারত বিভাজনের সম্ভাবনা রয়েছে।

(চ) ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া

ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ও এই প্রস্তাবের ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব বোধ করে।

উপসংহার:- সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করায় এই প্রস্তাব শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আসলে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায় কারুর কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন, “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক কাটার শামিল” (A post dated cheque on a crashing bank)।

Leave a Comment