উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় “ধর্ম” হতে আকবরের দীন-ই-ইলাহী সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হল।
আকবরের দীন-ই-ইলাহী সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা
প্রশ্ন:- আকবরের দীন-ই-ইলাহী সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা কর।
উত্তর:- ভূমিকা:- আকবরের ধর্মচিন্তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামে সমন্বয়ী ধর্মাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সেতুবন্ধনের উদ্দেশ্যে আকবর এই ধর্মমত প্রবর্তন করেন। বদাউনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সুফি সাধক শেখ তাজউদ্দিন আকবরকে এই নতুন ধর্মাদর্শ প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেন।
অর্থ ও তাৎপর্য
ফারসি শব্দ ‘দীন-ই-ইলাহি’-র অর্থ হল ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস (বা পবিত্র)। আবুল ফজল ও বদাউনি এই ধর্মমতকে ‘তৌহিদ-ই-ইলাহি’ বা স্বর্গীয় একেশ্বরবাদ বলে উল্লেখ করেছেন। সমস্ত ধর্মের সারবস্তু নিয়ে গঠিত হয় এই ধর্মমত।
মূলনীতি
‘দীন-ই-ইলাহি’-র মূল কয়েকটি নীতি ছিল –
- (ক) নিরামিষ আহার,
- (খ) দানধ্যান ও সমাজসেবা,
- (গ) একে অপরকে আল্লাহ্ আকবর (ঈশ্বর মঙ্গলময়) বলে সম্বোধন করা এবং প্রত্যুত্তরে জাল্লা জালাল্লাহ্ (তাঁর মহিমার বিকাশ হোক) বলা,
- (ঘ) অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা।
- (ঙ) সম্রাটের কাছে জীবন, ধর্ম, সম্পদ, মান বিসর্জনের প্রতিশ্রুতিদান করা।
প্রকৃতি
‘দীন-ই-ইলাহি’ ছিল একটি সমন্বয়ী ধর্মমত। এখানে উপনিষদের একেশ্বরবাদ, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অহিংস নীতি, পারসিকদের সূর্য ও অগ্নি উপাসনা এবং খ্রিস্টধর্মের সৌভ্রাতৃত্ববোধ গৃহীত হয়েছিল।
বৈশিষ্ট্য
- (ক) দীন-ই-ইলাহি ছিল সমস্ত ধর্মমতের একটি সংমিশ্রণ।
- (খ) এই ধর্মমতে কোনো দেবদেবীর স্থান ছিল না। সম্রাট নিজেই ছিলেন পির বা গুরু।
- (গ) পার্থিব উদারতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
- (ঘ) উদারতা, আত্মত্যাগ, মোহমুক্তি, নম্র বাক্যালাপ, নিরামিষ ভোজন, মদ্যপান ত্যাগ প্রভৃতি দীন-ই-ইলাহির অনুগামীদের পালনীয় কর্তব্য ছিল।
ফলাফল
- (ক) আকবর এই ধর্মমতের মাধ্যমে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে তুলে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব রক্ষার চেষ্টা করেন।
- (খ) সমস্ত ধর্মের সার নিয়ে গড়ে-ওঠা এই ধর্মমতের দ্বারা আকবর ভারতবর্ষকে সর্বধর্মসমন্বয়বাদী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন।
- (গ) আকবরের এই নতুন ধর্মমতের সুফল হিসেবে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উলেমা ও মোল্লাদের প্রভাব খর্ব হয়। সম্রাটের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার:- দীন-ই-ইলাহির আয়ু ছিল খুবই স্বল্প। আকবরের মৃত্যুর আগেই এর অবক্ষয় শুরু হয়। আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই ধর্মাদর্শের অবসান ঘটে।