গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের শক্তিশালী শাসক পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি প্রসঙ্গে পেরিক্লিসের বিদেশ নীতি, পেরিক্লিসের সাম্রাজ্য বিস্তার, পেরিক্লিসের রণনীতি, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের জন্য রণনীতি, পেরিক্লিসের রক্ষণাত্মক যুদ্ধ নীতি ও পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতির মূল্যায়ন সম্পর্কে জানব।
এথেন্সের শক্তিশালী শাসক পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি সম্পর্কে আলোচনা
বিষয় | ইতিহাস |
বিশ্ববিদ্যালয় | বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয় |
আর্টস | বি.এ. জেনারেল |
সেমিস্টার | দ্বিতীয় |
প্রশ্ন | পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি আলোচনা করো। |
প্রশ্নমান | ১০ |
পেরিক্লিসের বিদেশ নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে বেশ কিছু রাষ্ট্রকে জয় করেছিলেন। কিন্তু পারস্য ও স্পার্টার সঙ্গে তিনি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় পেলোপনেসীয় যুদ্ধে পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি প্রসঙ্গ।
পেলোপনেসীয় যুদ্ধ ছিল গ্রিস-এর দুটি পরস্পর বিরোধী মৈত্রী জোটের সংগ্রাম। স্পার্টার নেতৃত্বে পেলোপনেসীয় লীগের মধ্যে ছিল মেগারা, করিন্থ, ফোকিস্, লক্রিস, লিওকস্ প্রভৃতি নগররাষ্ট্র। এথেন্সের নেতৃত্বে ডোরীয় লীগের মধ্যে ছিল করকাইরা, প্ল্যাটিয়া, আকার্নেনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র। পেরিক্লিস বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধ আসন্ন। এছাড়া তিনি নিজের দেশের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি অনুধাবন করেন নৌশক্তিতে এথেন্স প্রবল শক্তিশালী হলেও স্থলযুদ্ধে স্পার্টা ও তার সহযোগীদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই তিনি পেলোপনেসীয় যুদ্ধের জন্য রণনীতি তৈরি করেন।
পেরিক্লিসের রণনীতি প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এ. জি. প্লাটিয়াস লিখেছেন পেরিক্লিস থেমিসটোসেলস-এর নীতি অনুসরণ করে যুদ্ধনীতি গড়ে তুলেছিলেন। এথেন্সের মূলত নৌশক্তিতে চূড়ান্ত আধিপত্য রয়েছে এবং পেলোপনেসীয় দেশগুলি স্থলবাহিনীর ক্ষেত্রে প্রচণ্ড শক্তিশালী। ঐতিহাসিক জে. ওবের-এর মতে এই কারণে পেরিক্লিস স্থলযুদ্ধে স্পার্টার সাফল্যে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পুনরায় এথেন্সে প্রাচীর তৈরীর কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। আর এর মধ্য দিয়ে পেরিক্লিস গ্রীসের আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বিকল্প শক্তি প্রয়োগের পথ দেখান।
থুকিডিডিসের বর্ণনা থেকে পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সময় পেরিক্লিসের রণনীতির বিভিন্ন দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন যেহেতু স্পার্টা ছিল স্থলযুদ্ধে শক্তিশালী তাই বার বার স্পার্টা এথেন্স আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। আর এই অবস্থায় স্থলশক্তিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এথেন্সকে রক্ষা করার জন্য পেরিক্লিস আত্মরক্ষামূলক নীতি অনুসরণ করেন। তিনি শত্রুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার উপর জোর দেন। এর ফলে এথেন্সের বাড়তি শক্তিক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়।
অন্যদিকে পেরিক্লিস যুদ্ধের সময় নতুন করে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দেন। এই সময়কালে নিজেদের শক্তিকে সংহত রাখাকেই তিনি প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই সময়ে পেরিক্লিস দুটি নীতির উপর জোর দেন – (ক) নতুন করে কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধের জড়িয়ে না পড়া। কারণ, পেরিক্লিস মনে করেছিলেন এই সময়ে নাগরিকদের যুদ্ধে যাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের রক্ষা করাই হবে প্রাথমিক কর্তব্য। (খ) এথেন্সের মিত্রশক্তিগুলির গতিবিধির উপর নজর রাখা এবং তারা যাতে শত্রপক্ষের সঙ্গে যোগ না দেয় তাও লক্ষ্য করা। পাশাপাশি এই সমস্ত দেশ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ আদায় করাকেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
থুকিডিডিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, পেরিক্লিস মনে করতেন শত্রুপক্ষ প্রথমেই এথেন্সের গ্রামগুলির উপর আক্রমণ করবে। তাই তিনি দেশের সমস্ত গ্রামবাসীকে নিজেদের ঘর-বাড়ি, সম্পত্তি প্রভৃতি ছেড়ে দিয়ে শহরে চলে আসার পরামর্শ দেন। তিনি এথেন্সবাসীর উদ্দেশ্যে দেশের স্বার্থে নিজেদের জীবন-সম্পত্তি তুচ্ছ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে পেরিক্লিস নৌবাহিনীর সাহায্যে পেলোপনেসীয় বাহিনীকে বিব্রত করে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে পেরিক্লিস প্রথমে এই আত্মরক্ষামূলক নীতি নিলেও ৪৩১-৪২৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়ে স্বয়ং আগ্রাসী যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে এপিডরাসকে বিধ্বংস করে দেন।
ঐতিহাসিক এ. জি. প্লাটিয়াস পেরিক্লিসের রণনীতি বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেন যে, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সময় পেরিক্লিস আত্মরক্ষামূলক ‘গ্ৰ্যান্ড স্ট্রেটিজ’’ গ্রহণ করেছিলেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রপক্ষকে হতোদ্যম করে তোলা এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। এই ঐতিহাসিকের মতে, এথেন্স বুঝতে পেরেছিল শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী স্পার্টাকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব নয় তাই স্পার্টার সামরিক পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক প্লাটিয়াস-এর মতে পেরিক্লিসের এই রক্ষণাত্মক যুদ্ধ নীতি এথেন্সের জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয় নি। তবুও পেরিক্লিসের প্রভাবে এথেন্সবাসী এই নীতি মেনে নিয়েছিল। পেরিক্লিসের রণনীতি প্রসঙ্গে জে. বি. বিউরি লিখেছেন তিনি মহাদেশ বিস্তারের নীতিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন এবং এথেন্সের সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার উপর জোর দেন। এথেন্সের জনগণের উদ্দেশ্যে পেরিক্লিস ঘোষণা করেন- “Let us give up lands and houses, but keep a watch over the city and the sea.” তিনি বলেন যেকোনো উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা সম্পত্তি ক্ষয় করব না।
পেরিক্লিসের উপরোক্ত রণনীতিকে বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক দুর্বল আত্মরক্ষামূলক ও ভ্রান্ত নীতি বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি ভালো রাজনীতিবিদ ও সুবক্তা ছিলেন কিন্তু সঠিক নীতি নির্ধারক ছিলেন না। তাই দেখা যায় পেরিক্লিসের এই আত্মরক্ষামূলক রণনীতি তাঁর মৃত্যুর পর এথেন্স বাতিল করে দেয় এবং আগ্রাসী যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে। বস্তুতঃ তাঁর এই নীতি বাস্তববাদী ছিল না। শত্রুপক্ষকে দুর্বল করে দিয়ে নিজের আত্মরক্ষার নীতিটি পরে মারাত্মক ভুল হিসেবে দেখা দেয়। শত্রুপক্ষের মাধ্যমে এথেন্সের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তথাপি সময়ের বিচারে পেরিক্লিসের এই নীতি ছিল সময়োপযোগী। ঐতিহাসিক V.D. Hanson Peloponnesian War গ্রন্থে তাই বলেছেন, “The Periclean strategy was not innovative, but could lead to a stagnancy in favour of Athens.”
(FAQ) পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১. পেরিক্লিস কে ছিলেন?
প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সের শক্তিশালী শাসক।
২. পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি প্রসঙ্গে কোন যুদ্ধের কথা বলা হয়?
পেলোপনেসীয় যুদ্ধ।
৩. পেরিক্লিসের যুদ্ধনীতি কেমন ছিল?
আত্মরক্ষামূলক।