গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা

খ্রিস্টপূর্ব যুগে গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন প্রসঙ্গে ধর্মকে কেন্দ্র করে গ্রীক ট্রাজেডির রূপরেখা রচনা, গ্রীক ট্রাজেডি মূলত ছিল ধর্মাশ্রিত এবং ধর্মকৃত্যের অঙ্গ, গ্রীক ট্রাজেডির ভাব ও রূপের সুনির্দিষ্টতায় বিভক্তিকরণ, গ্রীক ট্রাজেডিতে ইস্কাইলাস, গ্রীক ট্রাজেডির ক্লাসিক মর্যাদা ও গ্রীক ট্রাজেডির প্রবহমান ধারা সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা

বিষয়ইতিহাস
বিশ্ববিদ্যালয়বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়
আর্টসবি.এ. জেনারেল
সেমিস্টারদ্বিতীয়
প্রশ্নগ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন আলোচনা করো।
প্রশ্নমান১০
গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন আলোচনা করো।

ধর্মকে কেন্দ্র করে গ্রীক ট্রাজেডির রূপরেখা রচিত হয়েছে। ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রভাব গ্রীক ট্রাজেডির অপরিহার্য বিষয়। ইহলৌকিক জীবনে নানা বিশৃঙ্খলা ও মানসিক আপস ট্রাজেডির মূল কথা। গ্ৰীক ট্রাজেডির বিবর্তন আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায় যে পৃথিবীতে মাত্র দু’বার ট্র্যাজেডির সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি বা প্রকাশ ঘটেছে – (ক) পেরিক্লিসের আথেনাই নগরীতে এবং (খ) এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ড-এ। উৎপত্তির পর থেকেই গ্রীক ট্রাজেডিতে সময়ে সময়ে নানা বিবর্তন এসেছে। খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দী গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তনের স্বর্ণযুগ। এই স্বর্ণযুগের প্রতিনিধি হিসাবে ইস্কাইলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপিদিসের নাম স্মরণীয়। বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে প্রমাণিত গ্রীক ট্রাজেডিগুলিকে সরকারী দপ্তরে সসম্মানে সংরক্ষণ করা হত।

গ্রীক ট্রাজেডি মূলত ছিল ধর্মাশ্রিত এবং ধর্মকৃত্যের অঙ্গ। কিন্তু এই ধর্ম চিন্তার মধ্যেও স্পষ্ট বিবর্তনের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। গ্রীক ট্রাজেডির আদি সাহিত্যিক থেসপিসের জন্মস্থান আইকেরিয়া যেহেতু ডায়োনিসাসের পূজার অন্যতম পীঠস্থান ছিল, সেহেতু স্বাভাবিক ভাবেই তার মধ্যে ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই সময় গ্রীক ট্র্যাজেডির মূল কথা ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত মানব জীবনের মানসিক বিপর্যয়, অসহায়তা। এথেন্স সহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে খোলা আকাশের নীচে সমবেত দর্শকের সম্মুখে থেসপিস অভিনয় করতেন এবং মুখোশ, পোশাক পরিবর্তনের জন্য স্কেনের ব্যবহার শুরু করেন। ডায়োনিসাসের কাহিনী সহ তিনি অন্যান্য কাহিনীকেও নাটকের বিষয়বস্তু করেছিলেন। 

থেসপিসের পরবর্তীকালে কোয়েরিলাস প্লাতিনাস, ফ্রানিকাস প্রমুখ নাট্যকাররা বাৎসরিক নাটক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন এক অনস্বীকার্য ভূমিকা নেন। কোয়েরিলাস ৪৯৯ খ্রিস্ট পূর্বে সফোক্লিসের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। এরপর প্লাতিনাস গ্রীক ট্রাজেডিতে Satyric Drama-র প্রবর্তন করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁরা অধিকাংশ সময়ই থেসপিসের অনুকরণ করেছিলেন। তাঁদের সময় ট্রাজেডিতে যে বিবর্তন ঘটে তার পুরো কৃতিত্ব ট্র্যাজেডি আর ডিথরাম্বের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের নাটক রচনার প্রবর্তক প্লাতিনাসের।

পূর্বতন ট্রাজেডির ধারায় বিবর্তন ঘটিয়ে গ্রীক ট্রাজেডিকে ভাব ও রূপের সুনির্দিষ্টতায় বিভক্তিকরণ এবং বহিরঙ্গ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গের রস ভাব মিশ্রন ঘটিয়ে গ্রীক ট্রাজেডিকে এক নতুন রূপ দান করেছেন গ্রীক নাট্যকার ইস্কাইলাস। তিনি নাটকে কোরাসের ভূমিকাকে কিছুটা গৌণ করে দ্বি-নটরীতি প্রবর্তন করেছেন। নাটকের মধ্যে দুঃখ বিপর্যয়ের সঙ্গে নিয়তির সংগ্রাম, নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিরুদ্ধ শক্তির দ্বন্দের প্রবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইস্কাইলাস চিরস্মরণীয়। এছাড়াও তিনি গ্রীক ট্রাজেডি ধারণার প্রয়োগরীতির দিক দিয়ে নতুনত্ব আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু ছিল সংকীর্ণতামুক্ত। তিনি তিনটি ট্রাজেডির বিষয়বস্তুকে একই কাহিনীর ক্রম পরিণতি হিসাবে নাট্যরূপ দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর আগামেনন, কোয়েফোরোয় ও ইউমেনিদেস এই তিনটি নাটকের কথা বলা যায়। বলা যায় যে, ইস্কাইলাসের ট্রাজেডি ছিল স্বাতন্ত্রতায় ভরপুর।

ইস্কাইলাস গ্রীক ট্রাজেডিতে যে বিবর্তনের সূত্রপাত ঘটান তা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে সফোক্লিসের নতুন উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা। এরিস্টটল বলেছেন যে, স্থান-কাল-ক্রিয়ার নতুন ঐক্য এবং প্লটের জটিলতা ও নাটকীয়তার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম চিন্তাভাবনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে ট্রাজেডিকে সফোক্লিস তুলে ধরেছেন। তিনি অদৃষ্টকে অস্বীকার করেন নি। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য ছিল বক্তব্যের একমুখিনতা এবং কাহিনীর সামগ্রিকতা।

নাট্যকার ইউরিপিদিস এথেন্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধঃপতনের সময়কালে মানুষ এবং ইহজগতের মধ্যে আদর্শগত রূপটি অর্থাৎ বাস্তব জীবনের সমস্যাবহুল দিকটিকেই সবার উপরে রেখেছেন। তিনি এ্যানাক্সাগোরাসের কাছ থেকে সংশয়বাদের দীক্ষা এবং প্রোটাগোরাসের ধর্মবিরোধী গ্রন্থের পাঠ নিয়েছিলেন। জীবনের উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গীর বিস্তর প্রভেদ তাঁকে ইস্কাইলাস ও সফোক্লিস থেকে আলাদা করেছে। প্রচলিত ট্রাজেডিতে তিনি বৈপরীত্য ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য এনেছিলেন। তিনি রচনার সূচনায় ও উপসংহারে ‘প্রোলোগ’ ও ‘এপিলোগ’-এর সংযোজন করেছেন। ফলে তাঁর নাটক নিছক বিবৃতিমূলক একটি প্রচলিত রীতি না হয়ে জীবনমুখর ও শিল্পসমৃদ্ধ হয়েছে।

নাটক, অভিনয়, পরিচালনা, রচনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নাট্যকাররা ছিল খুবই সক্রিয় এবং এর ফলে এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে একটি পারিবারিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে যা বংশ পরস্পরায় সঞ্চারিত। উদাহরণস্বরূপ ইস্কাইলাসের দুই পুত্র, ইস্কাইলাসের ভ্রাতুষ্পুত্র প্রমুখরা গ্রীক ট্রাজেডির চর্চা ও চর্যায় রত ছিলেন। খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে যে একদল নতুন নাট্যকারের আবির্ভাব হয় তাঁরা গ্রীক ট্রাজেডি রচনা ও পরিচালনায় পেশাদার ছিলেন না। খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতকেও গ্রীক নাট্য জগতের প্রাণকেন্দ্র ছিল এথেন্স। এই শতকে এথেন্সে ইস্কাইলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপিদিসের ট্রাজেডিগুলির মধ্য দিয়ে পুরাতনের প্রতি অপরিসীম আনুগত্য প্রকাশিত হয়েছে। পুরাতন নাট্যধারাকে নতুন মৌলিকভাবে উজ্জ্বলতর করে তুলবার কোনো মানসিক সামর্থ্য নতুন যুগের নাট্যকারদের ছিল না। রাষ্ট্রীয় সামাজিক বা জাতীয় জীবনের অবক্ষয় ঘটার দরুন ঐক্যবোধ বা সংহতি আনয়নেও তা ব্যর্থ হয়। তাই পুরানো গ্রীক ট্রাজেডিই ক্লাসিক মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। 

গ্রীক ট্রাজেডি তার প্রবহমান ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে যে ক্লাসিক সম্পন্নতা অর্জন করেছিল তার কারণ বিশ্লেষণ করলে ট্র্যাজেডির স্বরূপ লক্ষণ পরিলক্ষিত হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে গ্রীক ট্রাজেডি ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও রুচির যে সূক্ষতর পরিবর্তন ঘটেছে তা ট্র্যাজেডিতে লক্ষিত হয়। প্রথমদিকে গ্রীক দেবতা ডায়োনিসাসের উৎসব ও পূজা সর্বত্র উদযাপিত হলেও পরবর্তীকালে ট্রাজেডির অভিনয়ের ধারাতে ডায়োনিসাসের উৎসবের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেই তা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য থেকে কখনোই পৃথক হয় নি। আলেকজান্ডার বিজয় অভিযান শেষে ট্র্যাজেডি অভিনয়ের আয়োজন করতেন। এছাড়াও পরবর্তীকালে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, এমন কি ভারতবর্ষ যেখানেই গ্রীক ভাবাপন্ন রাজারা রাজত্ব চালাতেন সেখানেই এই ট্র্যাজেডি অভিনয়ের ধারা বজায় রেখেছিলেন।

যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রীক ট্র্যাজেডির কাঠামো, আর্থিক বিন্যাস, বিষয় বস্তু-প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে নানা মৌলিক পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল। গ্রীক ট্র্যাজেডির আদি সাহিত্যিক থেসপিসের আমলে যে যাত্রার সূত্রপাত হয়, ইউরিপিদিসের সময় তার সমাপ্তি ঘটে।

(FAQ) গ্রীক ট্রাজেডির বিবর্তন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কার ট্রাজেডি ছিল স্বাতন্ত্রতায় ভরপুর?

ইস্কাইলাসের ট্রাজেডি ছিল স্বাতন্ত্রতায় ভরপুর।

২. গ্রিক ট্রাজেডির মূল কথা কী ছিল?

ইহলৌকিক জীবনে নানা বিশৃঙ্খলা ও মানসিক আপস ছিল গ্রিক ট্রাজেডির মূল কথা।

৩. কয়েকজন গ্রিক ট্রাজেডি রচয়িতার নাম লেখ।

ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিদিস প্রমুখ।

Leave a Comment