খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে নতুন ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের পটভূমি

উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় “ধর্ম” হতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে নতুন ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে নতুন ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের পটভূমি

প্রশ্ন:- খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে নতুন ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা :- খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক এক আলোড়নের যুগ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ শুরু হয় এবং বেশ কিছু নতুন ধর্মমতের উদ্ভব ঘটে।

(১) আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা

বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়। শ্রমণ ও পরিব্রাজক নামে দুটি সন্ন্যাসী গোষ্ঠীর প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে।

(২) যাগযজ্ঞের জটিলতা

বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মাচারণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। তার উপরে এই ব্যয়বহুল ধর্মাচারণ পদ্ধতির ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

(৩) ধর্মাচারণের অধিকার হ্রাস

ব্রাহ্মণধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে কমে যায়। নারীরাও বেদপাঠের অধিকার হারায়।

(৪) ধর্ম প্রচারকদের ভূমিকা

প্রচলিত বৈদিক ধর্ম সম্পর্কে মানুষ যখন সন্দিহান, তখন নতুন ধর্মের বিভিন্ন প্রচারক তাদের সহজ সরল ও উদার মতাদর্শ প্রচার করে মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। এই প্রসঙ্গে মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, গোসল মঙ্খলিপুত্র, অজিত কেশ কম্বলিন প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

(৫) ক্ষত্রিয়দের অসন্তোষ

বর্ণ প্রথার দ্বিতীয় স্তরে অবস্থানকারী ক্ষত্রিয়রা দেশের শাসক ও রক্ষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও ব্রাহ্মণদের মতো সমান মর্যাদা তারা পেতেন না।ফলে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ক্ষত্রিয়দের বিরোধ ক্রমে বাড়তে থাকে

(৬) বৈশ্যদের অসন্তোষ

বর্ণ প্রথার তৃতীয় স্তরে অবস্থানকারী বৈশ্যরা বাণিজ্যিক সাফল্যের দ্বারা অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বৈদিক ধর্মে বৈশ্যদের বাণিজ্যিক পেশাকে ঘৃণার চোখে দেখা হত। ফলে ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

(৭) শূদ্রদের অসন্তোষ

বর্ণ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থানকারী শূদ্ররা ছিল চরম অবহেলিত, বঞ্চিত, অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য এবং হীন। তাই তারা প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল।

(৮) কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গোরু বলি শুরু হলে নতুন কৃষি অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবাদী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম অহিংস নীতি প্রচার করে এবং গো-হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সাধারণ মানুষ নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

(৯) নগরায়ন ও বাণিজ্যের বিকাশ

কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতির ফলে কৃষির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন জমা হতে থাকে। উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রির জন্য নতুন নতুন বাজার গড়ে ওঠে এবং কৃষকদের আর্থিক সচ্ছ্বলতা আসে। যোগাযোগ ও অন্যান্য সুবিধার জন্য নদীর তীরে বিভিন্ন নগরের প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। এর ফলে নগরগুলিতে কৃষক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সামাজিক উত্থান সহজতর হয়।

(১০) বর্ণ প্রথার বিরোধিতা

বৈদিক যুগের বর্ণ প্রথা সমাজে অসাম্যের সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীকালে বৈদিক ধর্মে বর্ণ প্রথার কঠোরতা আরও বেড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে ব্যবধান ও বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকে। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণরা সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হিসাবে স্বীকৃত হয়। পূজার্চনা ও শিক্ষাদান করে তারা বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। অথচ যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বৈশ্য ও শূদ্ররা সমাজে ব্রাহ্মণদের দ্বারা পদদলিত হত। এর ফলে ব্রাহ্মণ্য বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে অন্যান্য বর্ণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

(১১) দার্শনিক কারণ

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষের মনে বুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে। এর ফল স্বরূপ এই সময় জন্মান্তরবাদ, কর্মফল, প্রভৃতি ধর্মাচরণকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সব মানুষকেই কর্মফল ভোগ করতে হবে।

(১২) ভাষাগত কারণ

বৈদিক আর্যদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ার জন্য তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে ছিল। অন্যদিকে বুদ্ধদেব আঞ্চলিক পালি ভাষায় ধর্মপ্রচার করার ফলে তা সর্ব সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায়, যে ধর্মকে মানুষের জীবনে সহজ সরলরূপে দেওয়ার ফলে নব্য ধর্মের উত্থান ঘটে। নব্য ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এক মানবতাবাদী জীবনমুখী ধর্মের অনুসন্ধানে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

Leave a Comment