উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায় ‘অর্থনীতির বিভিন্ন দিক’ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব কী ছিল? ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় নগরায়ণের কারণগুলি কী কী ছিল তা আলোচনা কর।
ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব
প্রশ্ন:- ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব কী ছিল? ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় নগরায়ণের কারণগুলি কী কী ছিল?
ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব
ভূমিকা :- ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব পড়েছিল ভারত এবং রোম উভয় দেশের ওপরেই। ভারত ও পাশ্চাত্য উভয় দেশই মূলত মৌর্যোত্তর যুগের সময়কালে বাণিজ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
(ক) ভারতের ওপর প্রভাব
ভারতের ওপর ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব ছিল নিম্নরূপ। –
(১) সমৃদ্ধিশালী নগরের উদ্ভব
ইন্দো-রোম বাণিজ্যের সুবাদে সাতবাহন শাসনাধীন দাক্ষিণাত্যে ও কুষাণ শাসনাধীনে উত্তর ভারতে বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী নগরের উদ্ভব ঘটে। দাক্ষিণাত্যে অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতে উদ্ভব ঘটেছিল এমন কয়েকটি নগর হল অমরাবতী, পৈঠান, সোপারা, কাবেরীপট্টনম প্রভৃতি। উত্তর ভারতে উদ্ভব ঘটেছিল মথুরা, বারাণসী, কৌশাম্বী প্রভৃতি নগর।
(২) শিল্প সংস্কৃতি
রোমান শিল্প সংস্কৃতির দ্বারা ভারতের শিল্প সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। বিশেষত ভারতীয় শিল্পের ওপর গ্রিক রোমান শিল্প ও স্থাপত্য শৈলীর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। ফলে ভারতে গান্ধার শিল্প নামে এক নতুন শিল্প রীতির উদ্ভব ঘটে। এছাড়া ভারতীয় মণিমুক্তার কারুকার্যের ওপরও রোমান শিল্প রীতির প্রভাব পড়েছিল।
(খ) রোমের ওপর প্রভাব
রোমের ওপর ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব ছিল নিম্নরূপ। –
(১) চিকিৎসা বিজ্ঞানে
রােম-ভারত বাণিজ্যের সুবাদে রােমে ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান-বিষয়ক ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে। ভারতীয়দের লতা-গুল্মভিত্তিক ভেষজ চিকিৎসাজ্ঞানের পরিচয় লাভ করে রােমানরা।
(২) মশলার ব্যবহারে
রােম-ভারত বাণিজ্যের সুবাদে রােমের বণিকরা দক্ষিণ ভারত থেকে মশলা কিনে দেশে নিয়ে যেত। রােমে ভারতীয় মশলার বিশেষ চাহিদা ছিল। ভারত থেকে বিভিন্ন প্রকারের মশলা রােমে রপ্তানি হওয়ার ফলে রােমানদের রন্ধন প্রণালী এবং খাদ্য তৈরিতে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন আসে৷
ভারতে তৃতীয় নগরায়ণ
ভূমিকা :- প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম হরপ্পা সভ্যতার যুগে নগর সভ্যতার সূচনা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ষোড়শ মহাজনপদের যুগে এবং তৃতীয় পর্যায়ে আদি মধ্যযুগে বহু নতুন নতুন নগরের উদ্ভব হয়। ভারতে নগরের উদ্ভবের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র গড়ে ওঠা
ড. রামশরণ শর্মার মতে, সামরিক ছাউনি, প্রশাসনিক কেন্দ্র, যাতায়াতের কেন্দ্র, শিল্পী ও কারিগরদের বসবাস, তীর্থক্ষেত্র প্রভৃতি স্থানে জনসমাগম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এখানে ক্রমে নগরের বিকাশ ঘটে।
(২) ধর্মস্থানের আকর্ষণ
ধর্মীয় কারণে ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানগুলিতে মানুষের যাতায়াত ও বসতি বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে এইসব স্থানকে কেন্দ্র করে নগর জীবনের প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রাবস্তী, বারাণসী, গয়া, রাজগৃহ, নালন্দা, পাটলিপুত্র প্রভৃতি স্থানগুলির সঙ্গে ধর্মপ্রচার ও নির্মাণের বিষয় যুক্ত হয়ে এগুলি জনপ্রিয় নগরে পরিণত হয়।
(৩) কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ
ডি. ডি কোশাম্বী ও ড. শর্মা নগরের উত্থানের পিছনে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন লোহার লাঙলের ব্যবহারের ওপর। লোহার লাঙল ব্যবহারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয়। উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা বাণিজ্য ও কারিগরী শিল্পের সূচনা সম্ভব হয়। ফলে শিল্প বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়এবং সেই সব স্থানে নগরের উন্মেষের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
(৪) রাজনৈতিক আধিপত্য
ঐতিহাসিক এ. এন. ঘোষ মনে করেন যে, রাজতন্ত্রের সূচনার পরবর্তীকালে রাজস্ব ব্যবস্থা, মুদ্রার প্রচলন, সেনাবাহিনী গঠন প্রভৃতির ফলে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রাজা তার নিজের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষকের উদ্বৃত্ত পণ্যের বড়ো অংশ দখল করে নেয়। এভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজার রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক আধিপত্য প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে রাজকীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রগুলি ক্রমে নগরায়ণের পথ প্রশস্ত করে।
উপসংহার :- এইভাবে বিভিন্ন কারণ একত্রিত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে তৃতীয় নগরায়ণের বিকাশ সাধনে সহায়তা করেছিল।