ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় “ধর্ম” হতে ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করা হল।

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

প্রশ্ন:- ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা :- ইউরোপের রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিভিন্ন অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল ধর্মসংস্কার আন্দোলন। এই ঘটনাকে অনেকে ধর্মবিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন

ষোড়শ শতকে ইউরোপে প্রচলিত পোপতন্ত্র এবং রোমান ক্যাথলিক ধর্মের কুসংস্কার, দুর্নীতি, অনাচার ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক তীব্র ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু পোপের নেতৃত্বাধীন ক্যাথলিক চার্চ-বিরোধী এই আন্দোলন ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত।

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

দীর্ঘকাল ধরে ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে মানুষের মনে এই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। এর বিভিন্ন কারণগুলি হল –

(১) পোপের আধিপত্য

খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ছিলেন সমগ্র খ্রিস্টান জগতের সর্বশক্তিমান ব্যক্তি।ইউরোপের যে কোনো শাসক সম্রাট এবং শাসিত সাধারণ মানুষ উভয়ের ওপরেই পোপতন্ত্রের সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সম্রাটের অভিষেকের ক্ষেত্রেও পোপের স্বীকৃতি লাভ বাধ্যতামূলক ছিল।আইন প্রণয়নেও পোপের মতামত নিতে রাজা বাধ্য ছিলেন। তবে পোপের এরূপ সীমাহীন আধিপত্য কিছু কিছু সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন তুলেছিল।

(২) নৈতিক অধঃপতন

খ্রিস্টান জগতের সর্বশক্তিমান অধিপতি পোপের সমালোচনা বা তাঁকে নিয়ন্ত্রনের অধিকার কারও ছিল না বলে পোপতন্ত্রের সীমাহীন অনাচার ও দুর্নীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। পোপের অধস্তন বিশপ ও যাজকরা ধর্মীয় ত্যাগের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে সীমাহীন বিলাস-বৈভবে জীবন কাটাতে থাকে। যাজকদের অনেকেই ছিলেন একাধিক অবৈধ সন্তানের পিতা। এককথায় নৈতিক জীবন ও চারিত্রিক সংযম তাঁদের ছিল না।যাজকদের এই অধঃপতন ও বিশৃঙ্খল নীতিভ্রষ্ট জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।

(৩) অর্থশোষন ও দুর্নীতি

এই সময় চার্চগুলি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। পোপ ও চার্চের নির্দেশে সাধারণ মানুষ বিশপ ও যাজকদের বিভিন্ন ধরনের কর দিতে বাধ্য হত। টাইদ বা ধর্মকর, অ্যানেট বা বাৎসরিক কর, জন্মকর, মৃত্যুকর প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। পোপের এই অর্থলালসা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি।

(৪) ইনডালজেন্স বিক্রি

চার্চের দুর্নীতির অন্যতম ছিল অর্থের বিনিময়ে ইনডালজেন্স বিক্রি। পোপ ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন।প্রচার করা হয় যে, যারা ইনডালজেন্স ক্রয় করবে তারা পার্থিব পাপ থেকে মুক্ত হবে এবং স্বর্গলাভ করবে। পোপের এরূপ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ-কর্মের ফলে কিছু সচেতন ধার্মিক মানুষ চার্চ ও ‌পোপতন্ত্রের প্রতি শ্রোদ্ধা হারায়। ফলে এই ইনডালজেন্স বিক্রয়কে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মনে ক্যাথলিক ধর্মবিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে।

(৫) রাজনৈতিক কারণ

চার্চ ও খ্রিস্টধর্ম সংগঠনের প্রধান হিসেবে পোপের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পোপ জনসাধারণের শ্রদ্ধা পান। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন রাজারা পোপ-বিরোধী হয়ে ওঠেন। কারণ, পোপ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মতপ্রকাশ করতে থাকেন।

(৬) মুদ্রণ বিপ্লব

মুদ্রণ বিপ্লব ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ শুরু হলে সাধারণ মানুষের কাজে ধর্মের মূল বক্তব্য পৌঁছে যায়। তারা উপলব্ধি করেন যে, পোপ ও যাজকরা ধর্মের নামে যে-সমস্ত কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন তার সাথে ধর্মের কোনো যোগ নেই। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল।

(৭) নবজাগরণও মানবতাবাদের প্রভাব

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে নবজাগরণের ফলে যে উদারচেতনা, যুক্তিবাদ, সমাজচেতনা, মানবতাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষ উদারতন্ত্রবাদের জন্ম হয়েছিল।এর ফলশ্রুতিতে শুরু হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন।

(৮) ধর্মসংস্কারকদের ভূমিকা

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনায় বিভিন্ন ধর্মসংস্কারকদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাঁরা প্রচলিত রীতিনীতির বিরোধীতা করে ধর্মসংস্কারের কথা বলেন। এঁদের মধ্যে জন ওয়াইক্লিফ, জন হাস, ইরাসমাস প্রমুখছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের ক্রিয়াকলাপ সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

(৯) নগরজীবনের বিকাশ

ষোড়শ শতকে ইউরোপে শিল্প ও বানিজ্যের বিকাশ, নগরের উদ্ভব, অর্থনৈতিক অগ্ৰগতি প্রভৃতির ফলে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।এই শ্রেনীর মানুষের ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ছিল না।তারা ক্রমে চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করে।এইভাবেই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়।

(১০) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব

ষোড়শ শতকে ইউরোপে বিভিন্ন শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ক্যাথলিক চার্চ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে।এইসব রাষ্ট্রের শাসকরা তাদের রাষ্ট্রে পোপের হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না।জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে সাধারণ মানুষ ও শাসকরা রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজেদের জাতীয় চার্চব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন।

(১১) প্রত্যক্ষ কারণ

লুথারের প্রতিবাদ :- ধর্মসংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন জার্মানির উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন লুথার। তিনি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পোপের অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে ৯৫ টি প্রশ্ন লিখে তা উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ঝুলিয়ে দেন এবং পোপের কাছ থেকে এগুলির উত্তর দাবি করেন। এখান থেকেই শুরু হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন।

উপসংহার :- জার্মানির মার্টিন লুথার ছিলেন ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রথিকৃত। তার প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই জার্মানি থেকে ক্রমে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে।

Leave a Comment