নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় হতে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর। নবম শ্রেণী (প্রথম অধ্যায়) ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর। Class 9 History Chapter 7 Analytical (MARKS-4) Question Answer in Bengali.
- ১। ফরাসি ‘অসিয়া রেজিম’ বা ‘পুরাতনতন্ত্র’ বলতে কী বোঝ?
- ২। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের আগে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল?
- ৩। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় যাজক সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
- ৪। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
- ৫। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় তৃতীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
- ৬। বিপ্লবের আগে ফরাসি রাজকোশ শূন্য হওয়ার প্রধান কারণগুলি কী ছিল?
- ৭। বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের বৈষম্যমূলক করব্যবস্থার পরিচয় দাও।
- ৮। ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচনায় দার্শনিক রুশোর কী ভূমিকা ছিল?
- ৯। দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে রাজা ষোড়শ লুই কর্তৃক নিযুক্ত অর্থমন্ত্রীরা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন?
- ১০। অভিজাত বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান?
- ১১। অভিজাত বিদ্রোহের গুরুত্ব উল্লেখ করো।
- ১২। বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পর্কে কী জান?
- ১৩। বুর্জোয়া বিপ্লবের গুরুত্ব উল্লেখ করো।
- ১৪। টেনিস কোর্টের শপথ সম্পর্কে কী জান?
- ১৫। বাস্তিলের পতন সম্পর্কে কী জান?
- ১৬। বাস্তিল দুর্গের পতনের গুরুত্ব কী ছিল?
- ১৭। ফরাসি বিপ্লবে গ্রাম্য জনতার ভূমিকার পরিচয় দাও।
- ১৮। ফরাসি বিপ্লবের প্রসারে গুজবের প্রভাব উল্লেখ করো।
- ১৯। ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণের বিবরণ দাও।
- ২০। ফরাসি সংবিধান সভার (১৭৮৯ খ্রি.) গঠন উল্লেখ করো।
- ২১। সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে ফ্রান্সের সংবিধান সভা (১৭৮৯ খ্রি.) কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল?
- ২২। টীকা লেখো : ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা।
- ২৩। ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব কী ছিল?
- ২৪। ফ্রান্সের নতুন আইনসভা (১৭৯১ খ্রি.) সম্পর্কে আলোচনা করো।
- ২৫। স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার অধিবেশন নিয়ে রাজার সঙ্গে জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিনদের বিরোধের পরিচয় দাও।
- ২৬। ফ্রান্সের নতুন আইনসভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দাও।
- ২৭। কীভাবে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই-এর মৃত্যুদণ্ড হয়?
- ২৮। ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কতটা সক্রিয় হয়েছিল?
- ২৯। জ্যাকোবিন শাসনের পরিচয় দাও।
- ৩০। মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের সঙ্গে জ্যাকোবিন ক্লাবের সম্পর্ক আলোচনা করো।
- ৩১। ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ কী?
- ৩২। নতুন ফরাসি সংবিধান (১৭৯৫ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
- ৩৩। ফ্রান্সে ‘ডাইরেক্টরির শাসনকাল’ (১৭৯৫-৯৯) সম্পর্কে কী জান?
- ৩৪। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব উল্লেখ করো।
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় হতে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর (ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক)
নবম শ্রেণী (প্রথম অধ্যায়) ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর
শ্রেণী | নবম |
অধ্যায় | প্রথম অধ্যায় |
Question Type | বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর |
Marks | 4 |
১। ফরাসি ‘অসিয়া রেজিম’ বা ‘পুরাতনতন্ত্র’ বলতে কী বোঝ?
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের আগে মধ্যযুগীয় যাজকতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়গুলি ফ্রান্সের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দৃঢ়ভাবে চেপে বসেছিল। ফ্রান্সের এই মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা সাধারণভাবে ‘পুরাতনতন্ত্র’ বা ‘অসিয়া রেজিম’ নামে পরিচিত।
অঁসিয়া রেজিম বা প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন দিক
ফরাসি অঁসিয়া রেজিম বা পুরাতনতন্ত্রের বিভিন্ন দিক ছিল। যেমন –
(১) স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র
ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের অধীনে তীব্র স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন। এজন্য তারা নিজেদের কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না। পুরাতনতন্ত্রের ধারক ও বাহক বুরবো বংশের রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ত্রয়োদশ লুই, চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই প্রমুখ।
(২) সামাজিক শ্রেণিভেদ
সমাজে শ্রেণিভেদ ও সামাজিক বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সমাজ মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল – যাজক শ্রেণি, অভিজাত শ্রেণি এবং বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, সাঁকুলোৎ প্রমুখদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় শ্রেণি। যাজক ও অভিজাতরা ছিল বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং তৃতীয় শ্রেণি ছিল সুবিধা বঞ্চিত ও নিপীড়িত শ্রেণি।
(৩) যাজক ও অভিজাতদের আধিপত্য
যাজক ও অভিজাতরা বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা সরকারকে কোনো কর দিত না। তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যাজকরা ‘টাইদ’ বা ধর্মকর, অভিজাত প্রভুরা ‘করভি’ বা শ্রমকর-সহ বিভিন্ন সামন্তকর আদায় করত।
(৪) ভিত্তি
ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, যাজক ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের ওপরই ফরাসি রাজার স্বৈরাচার ও ‘পুরাতনতন্ত্র’ দাঁড়িয়েছিল। এজন্য এই বিশেষ অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে সমগ্র ‘পুরাতনতন্ত্র’-ই কেঁপে উঠত।
উপসংহার :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা’-র দ্বারা ফরাসি সংবিধান সভা ‘বিশেষ অধিকার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার ও সাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে।’ ঐতিহাসিক ওলার এই ঘোষণাপত্রকে ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু-পরোয়ানা’ বলে অভিহিত করেছেন।
২। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের আগে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা ছিল মধ্যযুগীয়, সামন্ততান্ত্রিক এবং অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। সমাজের মানুষ সাধারণত তিনটি সম্প্রদায় বা ‘এস্টেট’-এ বিভক্ত ছিল – যাজকদের নিয়ে গঠিত প্রথম সম্প্রদায়, অভিজাতদের নিয়ে গঠিত দ্বিতীয় সম্প্রদায় এবং বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, দরিদ্র কৃষক-শ্রমিক ও সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় সম্প্রদায়।
প্রথম সম্প্রদায়
যাজক সম্প্রদায় ছিল সমাজের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণি। তাদের মোট জনসংখ্যা ১ শতাংশের কম হলেও দেশের ১/৫ অংশ কৃষিজমিই ছিল তাদের হাতে। এর জন্য তারা রাজাকে কোনো কর দিত না। গির্জার আয় এবং আদায় করা ধর্মকর, মৃত্যুকর, বিবাহকর প্রভৃতি ব্যয় করে তারা অত্যন্ত বিলাসিতায় দিন কাটাত।
দ্বিতীয় সম্প্রদায়
অভিজাতরা ছিল অপর সুবিধাভোগী শ্রেণি। অভিজাতদের মোট জনসংখ্যা মাত্র ১.৫ শতাংশ হলেও দেশের ১৩ অংশ কৃষিজমিই ছিল তাদের হাতে। এর জন্য তারা রাজাকে কোনো ভূমিকর দিত না। তারা প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সামন্তকর আদায় করত এবং প্রশাসন ও বিচারবিভাগের উচ্চপদগুলি দখল করত।
তৃতীয় সম্প্রদায়
বুর্জোয়া, ধনী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা ভবঘুরে বা সাঁকুলোৎ প্রমুখ ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। দেশের অন্তত ৯৮ শতাংশ জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো সুযোগসুবিধা পেত না। তারা বিভিন্ন ধরনের করভারে জর্জরিত ছিল।
উপসংহার :- লেফেভর, জোরেস, সালভেমিনি প্রমুখ ঐতিহাসিক সামাজিক অসাম্যকে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৩। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় যাজক সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের আগে ফরাসি সমাজে যে তিনটি প্রধান সম্প্রদায় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল যাজকদের নিয়ে পঠিত প্রথম সম্প্রদায়।
যাজক সম্প্রদায়ের বিশেষত্ব
ফরাসি সমাজে যাজক সম্প্রদায়ের কতকগুলি বিশেষত্ব ছিল। যেমন –
(১) জনসংখ্যা
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যাজকদের মোট সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার, দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৫ শতাংশ। অতি অল্প জনসংখ্যা হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রে যাজকদের সীমাহীন প্রতাপ ছিল।
(২) জমি থেকে আয়
যাজকদের জনসংখ্যা অতি সামান্য হলেও ফ্রান্সের মোট কৃষিজমির ১/৬ অংশই ছিল তাদের অধীনস্থ গির্জার হাতে। এই জমির জন্য তারা সরকারকে কোনো কর দিত না। তারা ‘কনট্রাক্ট অব পোইসি’ নামে এক চুক্তি অনুসারে রাজাকে একটি স্বেচ্ছাকর দিত। গির্জার এই জমি থেকে বছরে প্রায় ১৩ লক্ষ লিভ্র আয় হত।
(৩) কর আদায়
যাজকরা জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করত। এই সব করের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘টাইদ’ বা ধর্মকর, মৃত্যুকর, বিবাহকর প্রভৃতি।
(৪) যাজকদের বিভাগ
যাজকরা মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল – বিশপ, ক্যানন, মঠাধ্যক্ষ প্রমুখদের নিয়ে গঠিত উচ্চ যাজক এবং গ্রামের দরিদ্র সাধারণ পাদরিদের নিয়ে গঠিত নিম্ন যাজক। উচ্চ যাজকরা গির্জার আয়ের বেশিরভাগই ভোগ করত এবং অত্যন্ত বিলাসব্যসনে জীবন কাটাত। এজন্য নিম্ন যাজকরা তাদের ঈর্ষা ও ঘৃণা করত।
উপসংহার :- অধ্যাপক সালভেমিনি বলেছেন যে, “উচ্চ ও নিম্ন যাজকদের বিবাদ ফরাসি বিপ্লবের প্রাথমিক সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল।”
৪। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের আগে ফরাসি সমাজে যে তিনটি প্রধান সম্প্রদায় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল অভিজাতদের নিয়ে গঠিত দ্বিতীয় সম্প্রদায়।
অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষত্ব
ফরাসি সমাজে অভিজাত সম্প্রদায়ের কতকগুলি বিশেষত্ব ছিল। যেমন –
(১) জনসংখ্যা
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে অভিজাতদের মোট সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার, দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ। এই স্বল্প জনসংখ্যা সত্ত্বেও অভিজাত সম্প্রদায় ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রে সীমাহীন প্রভাব-প্রতিপত্তি ভোগ করত।
(২) আয়
স্বল্প জনসংখ্যা সত্ত্বেও ফ্রান্সের মোট কৃষিজমির ১/৩ অংশই ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে। এই বিপুল পরিমাণ কৃষিজমির জন্য তারা সরকারকে কোনো ভূমিকর দিত না। এমনকি ভিটিংয়েমে বা ক্যাপিটেশন করও না। বরং তারা প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন জরিমানা, বানালিতে, করভি-সহ বিভিন্ন ধরনের সামন্তকর আদায় করে বিপুল অর্থ উপার্জন করত।
(৩) প্রতিপত্তি
ফরাসি সমাজে অভিজাত সম্প্রদায়ের সীমাহীন প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তারা রাজদরবার থেকে বিভিন্ন ভাতা, পুরস্কার ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করত। বিচারবিভাগ ও প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে এবং সরকারি চাকরির নিয়োগে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।
উপসংহার :- অভিজাতরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে জন্মসূত্রে অভিজাতদের বংশকৌলিন্য থাকলেও পোশাকি অভিজাতদের তা ছিল না। তাই জন্মসূত্রে অভিজাতরা তাদের ঘৃণা করত।
৫। ফরাসি সমাজব্যবস্থায় তৃতীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের আগে ফরাসি সমাজে বিদ্যমান তিনটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম ছিল বুর্জোয়া, কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা ভবঘুরে বা সাঁকুলোৎ প্রমুখদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় সম্প্রদায়।
তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিশেষত্ব
ফরাসি সমাজে তৃতীয় সম্প্রদায়গুলির বিশেষত্ব গুলি হল –
(১) জনসংখ্যা
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশ। এই বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও তৃতীয় সম্প্রদায় ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রে কোনো অধিকার পেত না।
(২) শ্রেণিবিভাগ
ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায় মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা – ধনী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক, প্রমুখ ছিল উচ্চ বুর্জোয়া; আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক প্রমুখ ছিল মধ্য বুর্জোয়া এবং কারিগর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি ছিল নিম্ন বুর্জোয়া।
(৩) সামাজিক অবস্থা
বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের ধনী অংশ বিদ্যা-বুদ্ধি বা অর্থসম্পদে অভিজাত সম্প্রদায়ের চেয়েও অগ্রসর ছিল। কিন্তু অভিজাতদের মতো বংশকৌলিন্য তাদের না থাকায় তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা অবিচারের শিকার হয়েছিল। তারা অভিজাত সম্প্রদায়ের ঘৃণার পাত্র ছিল।
(৪) করভার
তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ নানা করভারে জর্জরিত ছিল। দেশের মোট রাজস্বের ৯৬ শতাংশই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হত। রাষ্ট্র, গির্জা ও সামন্তপ্রভুরা তাদের কাছ থেকে ভূমিকর, উৎপাদন কর, আয়কর, লবণকর, ধর্মকর প্রভৃতি আদায় করত।
উপসংহার :- ধনী বা মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারা ছিল ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত। ঐতিহাসিক লাব্রুজ বলেছেন যে, “অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত।”
৬। বিপ্লবের আগে ফরাসি রাজকোশ শূন্য হওয়ার প্রধান কারণগুলি কী ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের আগে ফরাসি অর্থনীতি চরম সংকটের সম্মুখীন হয় এবং রাজকোশ একপ্রকার শূন্য হয়ে যায়। বিপ্লবের আগে ফরাসি রাজকোশ শূন্য হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) ত্রুটিপূর্ণ রাজস্বব্যবস্থা
যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২-৩ শতাংশ হলেও তারাই ছিল দেশের মোট কৃষিজমির বৃহদংশের মালিক। এই জমির জন্য তারা সরকারকে কোনো বাধ্যতামূলক কর না দেওয়ায় সমস্ত রাজস্বের বোঝা বহন করতে হত দরিদ্র কৃষকদের। দেশের অন্তত ৯৬ শতাংশ রাজস্বই তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আদায় করা হত।
(২) যুদ্ধনীতি
বিভিন্ন ফরাসি রাজা বিভিন্ন যুদ্ধে যোগ দিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ লুই বিভিন্ন যুদ্ধে যোগ দিয়ে রাজকোশের বিপুল অর্থব্যয় করেন। ষোড়শ লুই-এর আমলেও এই ব্যয় অব্যাহত থাকে। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে রাজকোশের অর্থ অকাতরে ব্যয় করেন।
(৩) অমিতব্যয়িতা
ফরাসি রাজপরিবারের সীমাহীন বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতার ফলে রাজকোশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যায়। গুডউইন বলেছেন যে, ভার্সাই রাজসভায় কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার। রানির খাস চাকর ছিল ৫০০ জন।
(৪) ঋণ সংগ্রহ
সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ সংগ্রহ করে দেশের আর্থিক সংকট আরও বৃদ্ধি করে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজকোশ থেকে বেরিয়ে যায়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক গুডউইন বলেন যে, ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সমস্যার প্রধান কারণ ছিল, বিপুল ব্যয়ভার হ্রাস করতে সরকারের অক্ষমতা।
৭। বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের বৈষম্যমূলক করব্যবস্থার পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বিপ্লব-পূর্ববর্তী ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ভ্রান্ত অর্থনীতির অন্যতম দিক ছিল দেশের বৈষম্যমূলক ও বিভ্রান্তিমূলক করব্যবস্থা। কারণ, করব্যবস্থায় ‘অধিকারভোগী’ যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় এবং ‘অধিকারহীন’ তৃতীয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের জন্য পৃথক নীতি ছিল।
অধিকারভোগী শ্রেণি
‘অধিকারভোগী’ যাজক ও অভিজাতদের হাতে ফ্রান্সের ৫০ শতাংশেরও বেশি কৃষিজমি ছিল। অথচ এই বিপুল পরিমাণ জমির জন্য তারা সরকারকে কোনো প্রকার কর প্রদানে বাধ্য ছিল না। তারা রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করত তার জন্যও তাদের কোনো কর দিতে হত না।
অধিকারহীন শ্রেণি
অধিকারভোগী সম্প্রদায়গুলি কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়কে করের বিপুল বোঝা বহন করতে হত। ঐতিহাসিক লাব্রুজ বলেছেন যে, “অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত শ্রেণি।” দেশের সমগ্র রাজস্বের ৯৬ শতাংশই তৃতীয় সম্প্রদায়কে দিতে হত।
বিভিন্ন কর
রাষ্ট্র, সামন্তপ্রভু ও গির্জা তৃতীয় শ্রেণির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করত। করগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘টাইলে’ বা ভূমিকর, ‘ক্যাপিটেশন’ বা উৎপাদন কর, ‘ভিটিংয়েমে’ বা আয়কর, ‘গ্যাবেলা’ বা লবণকর, ‘টাইদ’ বা ধর্মকর এবং ‘করভি’ বা বাধ্যতামূলক বেগার শ্রমদান প্রভৃতি। এত রকম কর মিটিয়ে কৃষকের হাতে তার মোট আয়ের মাত্র ১/৫ অংশ অবশিষ্ট থাকত যা দিয়ে তার পরিবারের ভরণ-পোষণ চলত না।
উপসংহার :- দেশে আর্থিক সংকটের ফলে ফরাসি অর্থমন্ত্রী ক্যালোন সকল সম্প্রদায়ের ওপর ভূমিকরের প্রস্তাব দিলে অভিজাতরা এর প্রতিবাদ করে।
৮। ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচনায় দার্শনিক রুশোর কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- যে-কোনো বিপ্লবের আগে মানুষের ভাবজগতে বিপ্লবী চেতনার বিকাশ ঘটা দরকার। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) সংঘটনের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বিভিন্ন ফরাসি দার্শনিক। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দার্শনিক জ্য জ্যাক রুশো।
রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা খণ্ডন
অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় দার্শনিক ছিলেন জ্যঁ জ্যাক রুশো। তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সামাজিক চুক্তি’ (Social Contract)-তে রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেন।
জনগণের ইচ্ছা
তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির উৎস হল জনগণ। কারণ, ‘জনগণের ইচ্ছা’ অনুসারেই একদিন চুক্তির দ্বারা রাজা শাসনক্ষমতা লাভ করেছিলেন। তাই রাজাকে যে-কোনো সময় ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে।
বৈষম্যের বিরোধিতা
তিনি তাঁর ‘অসাম্যের সূত্রপাত’ গ্রন্থে বলেন যে, মানুষ স্বাধীন হয়ে এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মায়। কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা তাকে দরিদ্র ও পরাধীন করে।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক হ্যাসাল বলেছেন, “ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণের সমন্বয় থাকলেও রুশোর রচনার প্রভাব অনস্বীকার্য।”
৯। দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে রাজা ষোড়শ লুই কর্তৃক নিযুক্ত অর্থমন্ত্রীরা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন?
উত্তর:- ভূমিকা :- রাজপরিবারের সীমাহীন অমিতব্যয়িতা, ত্রুটিপূর্ণ রাজস্বব্যবস্থা, যুদ্ধে বিপুল ব্যয়, ঋণের সুদ প্রদান প্রভৃতির ফলে ফরাসি রাজকোশ একপ্রকার শূন্য হয়ে পড়ে। এই সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে ষোড়শ লুই বিভিন্ন অর্থমন্ত্রীদের নিযুক্ত করেন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তুর্গো-এর সংস্কার
ষোড়শ লুই-এর অর্থমন্ত্রী তুর্গো রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা, সরকারি ব্যয়, যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যয় প্রভৃতি কমানোর কথা বলেন এবং যাজক ও অভিজাতদের ওপর ভূমিকর আরোপের প্রস্তাব দেন। ফলে রানি আঁতোয়ানেত ও অভিজাতদের চাপে তাঁর পতন (১৭৭৬ খ্রি.) ঘটে।
নেকার-এর সংস্কার
পরবর্তী অর্থমন্ত্রী নেকার (১৭৭৬- ৮১ খ্রি.) রাজপরিবারের ব্যয়সংকোচন ও ধনী নাগরিকদের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব দেন। ফলে রানি ও অভিজাতদের চাপে তিনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ক্যালোন-এর সংস্কার
পরবর্তী অর্থমন্ত্রী ক্যালোন (১৭৮৩-৮৭ খ্রি.) সকল সম্প্রদায়ের ওপর ভূমিকর আরোপ, লবণকর আরোপ, অবাধ বাণিজ্যনীতির প্রবর্তন, করভি বিলোপ, অন্তঃশুল্ক বিলোপ প্রভৃতির প্রস্তাব দেন। নেতৃস্থানীয় অভিজাতদের নিয়ে ‘গণ্যমান্যদের পরিষদ’ ক্যালোনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।
ব্রিয়াঁ-এর সংস্কার
পরবর্তী অর্থমন্ত্রী ব্রিয়াঁ (১৭৮৭-৮৮ খ্রি.) স্ট্যাম্পকর ও ভূমিকরের প্রস্তাব দিলে ‘প্যারিসের পার্লামেন্ট’ তার বিরোধিতা করে। তাঁরা দাবি করে যে, কর আরোপের একমাত্র অধিকারী স্টেটস জেনারেলের অনুমতি ছাড়া কর চাপানো যাবে না।
উপসংহার :- ইতিমধ্যে রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে তীব্র বিরোধ শুরু হলে রাজার বিরুদ্ধে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যাজক এবং বুর্জোয়ারাও অভিজাতদের পক্ষে শামিল হয়। বিদ্রোহের চাপে রাজা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
১০। অভিজাত বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই-এর অর্থমন্ত্রী ব্রিয়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে অভিজাতদের ওপরও করারোপের প্রস্তাব দিলে অভিজাত সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাজার সঙ্গে অভিজাতদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
স্টেটস জেনারেলের অধিকার
অভিজাতরা ব্রিয়াঁর কয়েকটি প্রস্তাব মেনে নিলেও স্ট্যাম্পকর ও ভূমিকরের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। তারা দাবি করে যে, একমাত্র স্টেটস জেনারেলের কর আরোপের অধিকার আছে।
পার্লামেন্টের সদস্যদের নির্বাসন
ষোড়শ লুই পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের আচরণে উত্ত্যক্ত হয়ে নিজের ভাই ডিউক অব অর্লিয়েন্স-সহ তিনজন সদস্যকে নির্বাসিত করেন। এতে পার্লামেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং রাজার বিরুদ্ধে কয়েকটি আইন পাশ করে ইচ্ছামতো নাগরিকদের গ্রেপ্তার, বিচারকদের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়ে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
পার্লামেন্ট মুলতুবি
পার্লামেন্টের আইনে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা সমস্ত প্রদেশের পার্লামেন্টগুলি মুলতুবি করেন এবং ৫৭টি নতুন বিচারালয় স্থাপন করে নিজের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলিকে আইনে পরিণত করেন।
বিদ্রোহের সূচনা
রাজা পার্লামেন্ট মুলতুবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। তুলোঁ, দ্যাফিনে, দুজোঁ প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
গুরুত্ব
অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে নিজের অজ্ঞাতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের মূলেই কুঠারাঘাত করে।
উপসংহার :- অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে যাজক ও বুর্জোয়ারা শীঘ্রই বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে এটি গণবিদ্রোহের রূপ লাভ করে। ঐতিহাসিক লেফেভর বলেছেন যে, “বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে এবং জয়যুক্ত হয়।”
১১। অভিজাত বিদ্রোহের গুরুত্ব উল্লেখ করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেশের সমস্ত প্রাদেশিক পার্লামেন্ট মুলতুবি করেন এবং সকল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কর আদায়ের উদ্যোগ নিলে ক্ষুব্ধ হয়ে সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। অভিজাত বিদ্রোহের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(১) ফরাসি বিপ্লবের সূচনা
অভিজাত বিদ্রোহ থেকেই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়। বিদ্রোহের প্রথম পর্বে অভিজাতদের সহযোদ্ধা ছিল বুর্জোয়ারা। দ্বিতীয় পর্যায়ে বুর্জোয়ারা এবং শেষ পর্যায়ে কৃষকরা বিদ্রোহের নেতৃত্বের আসন দখল করে।
(২) গণবিদ্রোহের সোপান
রাজার বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহে শীঘ্রই যাজক ও বুর্জোয়ারা শামিল হয়। ফলে অভিজাত বিদ্রোহ কিছুকাল পরই প্রকৃত গণবিদ্রোহে পরিণত হয়।
(৩) রাজতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত
অভিজাত বিদ্রোহের চাপে রাজা স্টেট্স জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। ফলে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত লাগে। রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
(৪) পুরাতনতন্ত্রের ওপর আঘাত
রাজা ছিলেন ফরাসি পুরাতনতন্ত্র ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের রক্ষক। অভিজাতরা রাজতন্ত্রকে দুর্বল করতে গিয়ে পুরাতনতন্ত্রকেই দুর্বল করে দেয়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক সেতোব্রিয়াঁ বলেছেন যে, “ফরাসি বিপ্লবের সূচনা করে অভিজাতরা এবং বিপ্লব সম্পূর্ণ করে তৃতীয় শ্রেণি।”
১২। বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পর্কে কী জান?
উত্তর:- ভূমিকা :- অভিজাত বিদ্রোহের চাপে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই বাধ্য হয়ে ৫ মে (১৭৮৯ খ্রি.) স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার অধিবেশন ডাকেন। এই সভায় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
বুর্জোয়া প্রতিনিধি
জাতীয় সভার মোট ১২১৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে যাজকদের ৩০৮ জন, অভিজাতদের ২৮৫ জন এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের ৬২১ জন সদস্য ছিল। ইতিপূর্বে জাতীয় সভার প্রতিনিধিরা সম্প্রদায় অনুসারে তিনটি পৃথক কক্ষে বসত।
ভোটদান পদ্ধতি
জাতীয় সভায় সদস্যদের মাথাপিছু নয়, সম্প্রদায়-পিছু ভোট হত। অর্থাৎ যাজক, অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের তিনটি ভোট ছিল। যাজক ও অভিজাতদের স্বার্থ একই ধরনের হওয়ায় তারা সর্বদা একপক্ষে ভোট দান করত। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যাজক ও অভিজাতদের মিলিত ২টি ভোট সর্বদা তৃতীয় শ্রেণির ১টি মাত্র ভোটকে পরাজিত করত।
বিদ্রোহের সূত্রপাত
সভার অধিবেশন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা সকল প্রতিনিধিদের একটি কক্ষে বসা এবং সম্প্রদায়-পিছু ভোটের পরিবর্তে মাথাপিছু ভোটের দাবি করে। প্রথম দুই সম্প্রদায় ও রাজা এই দাবির বিরোধিতা করলে অধিবেশনের বুর্জোয়ারা বিদ্রোহ শুরু করে।
বিদ্রোহের তীব্রতা
মিরাবো, লাফায়েৎ, আবে সিইয়েস প্রমুখ উদারপন্থী অভিজাত তৃতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিলে বুর্জোয়া বিদ্রোহ তীব্রতর হয়ে ওঠে। তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের সভাকেই ‘জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করে। ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি এই ঘটনাকে ‘ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার :- বুর্জোয়া বিদ্রোহের চাপে আতঙ্কিত হয়ে রাজা ষোড়শ লুই ২৭ জুন তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন।
১৩। বুর্জোয়া বিপ্লবের গুরুত্ব উল্লেখ করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- দীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাই নগরীতে স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা একই কক্ষে বসা এবং মাথাপিছু ভোটের দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করলে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হয়। বুর্জোয়া বিপ্লবের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(১) তৃতীয় সম্প্রদায়ের জয়
বুর্জোয়া শ্রেণির বিদ্রোহের চাপে আতঙ্কিত রাজা ২৭ জুন তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন এবং মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। ফলে বুর্জোয়াদের গুরুত্বপূর্ণ জয় হয়।
(২) ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত
বুর্জোয়া বিপ্লব জয়যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনা থেকে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। বুর্জোয়াদের বিপ্লবে কিছুদিনের মধ্যেই তৃতীয় শ্রেণির দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকরা যোগ দেয়।
(৩) প্রতিক্রিয়াশীলতা
বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও সক্রিয় থাকে। কারণ, বুর্জোয়াদের সাফল্য রাজা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। অভিজাতরাও বুর্জোয়াদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় রাজি ছিল না। ফলে অনমনীয় রাজা নতুন করে সৈন্য সমাবেশ করলে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
(৪) গণবিদ্রোহ
বুর্জোয়া বিপ্লবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকরা যোগ দিলে ফরাসি বিপ্লব প্রকৃত গণবিদ্রোহে পরিণত হয়। গ্রামেগঞ্জে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিসের উত্তেজিত বিদ্রোহীরা ১৪ জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটায়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি বুর্জোয়া বিদ্রোহের তীব্রতাকে ‘ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।
১৪। টেনিস কোর্টের শপথ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর:- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে নব নির্বাচিত জাতীয় সভার প্রথম অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সকল সদস্যের একই কক্ষে বসা এবং মাথাপিছু ভোটের দাবিতে সরব হয়।
বুর্জোয়াদের ক্ষোভ
তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিদের দাবি রাজা নাকচ করলে ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা ১৭ জুন এক সভায় নিজেদের সভাকে ‘প্রকৃত জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করে এবং দাবি করে, করধার্য করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি এই ঘটনাকে ‘ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক’ বলে অভিহিত করেন।
শপথ গ্রহণ
তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ২০ জুন তাদের সভাকক্ষে গিয়ে দেখেন যে, সভাকক্ষটি তালাবন্ধ রয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা মিরাবো ও আবে সিয়েস- এর নেতৃত্বে নিকটবর্তী টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়। সেখানে তারা শপথ গ্রহণ করে যে, যতদিন না তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবে। এই ঘটনা ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ নামে পরিচিত।
রাজার ভূমিকা
টেনিস কোর্টের শপথের ৩ দিন পর তিন সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ অধিবেশনে রাজা প্রথম দুই শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সমস্ত দাবি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। এরপর রাজা সভাকক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সেনা অভিযানের হুমকি উপেক্ষা করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন।
পরিণতি
শেষপর্যন্ত চাপে পড়ে রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নেন। এভাবে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্ব সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়।
উপসংহার :- টেনিস কোর্টের মাঠে বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের সাথে উদারপন্থী ১৩৯ জন (কোবানের মতে ১৭০ জন) যাজক এবং ৪৭ জন (কোবানের মতে ৫০ জন) অভিজাত প্রতিনিধি যোগ দিলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের শক্তি বৃদ্ধি পায়। বুর্জোয়া নেতা বেইলি ঘোষণা করেন যে, “তৃতীয় শ্রেণির সভাই হল প্রকৃত জাতীয় সভা”।
১৫। বাস্তিলের পতন সম্পর্কে কী জান? অথবা, প্যারিসে সাধারণ মানুষের উদ্যোগে বিপ্লবের প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই বুর্জোয়াদের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। এই ঘটনা ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের মনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে।
রাজার পদক্ষেপ
প্রবল চাপে পড়ে ষোড়শ লুই বুর্জোয়াদের দাবি মেনে নিলেও তিনি মন থেকে এই ঘটনা মানতে পারেন নি। তিনি প্যারিস ও ভার্সাই-এ প্রায় ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করেন। এরপর ষোড়শ লুই জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করে।
উন্মত্ত জনতা
নেকারের পদচ্যুতির ফলে প্যারিসের উন্মত্ত জনতা হিংসার পথে পা বাড়ায়। রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি হয়, জনতা অস্ত্রের দোকান ও গির্জাগুলিতে লুণ্ঠন চালায়।
প্যারিসের পরিস্থিতি
এই সময় খাদ্যের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে এসে প্যারিসের উত্তেজিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিত হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সশস্ত্র জনতা সরকারি দপ্তরগুলিতে আক্রমণ চালিয়ে বহু নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। এরপর ৭-৮ হাজার মানুষ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের রক্ষীদের হত্যা করে দুর্গটি দখল করে এবং বন্দিদের মুক্ত করে দেয়।
গুরুত্ব
বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরশাসনের প্রতীক। বিনা বিচারে বহু নিরপরাধ মানুষকে এখানে বন্দি করে রাখা হত। বাস্তিলের পতনে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের ওপর তীব্র আঘাত নেমে আসে। প্যারিসের শাসনক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়। ‘প্যারি কমিউন’ গঠন করে তারা প্যারিসের শাসন চালাতে থাকেন। ঐতিহাসিক গুডউইনের মতে, “বাস্তিলের পতনের ঘটনা সমগ্র বিশ্বে স্বাধীনতার উন্মেষকাল হিসেবে চিহ্নিত।”
উপসংহার :- বাস্তিলের পতনের ফলে প্রমাণ হয় যে, প্যারিসের ওপর রাজার আর নিয়ন্ত্রণ নেই। ঐতিহাসিক গুডউইন বলেছেন, “বিপ্লবে বাস্তিলের পতনের মতো বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা আর ঘটে নি।”
১৬। বাস্তিল দুর্গের পতনের গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই বুর্জোয়াদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করলেও তিনি পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত এবং প্যারিস ও ভার্সাইয়ে সেনা মোতায়েন করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্যারিসের জনতা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ ও দখল করে নেয়। বাস্তিল দুর্গের পতনের গুরুত্ব হল –
(১) রাজার নতিস্বীকার
বাস্তিলের পতনের পর আতঙ্কিত রাজা প্যারিসে এসে বিপ্লবের তেরঙা (লাল-নীল-সাদা) পতাকাকে ফ্রান্সের প্রতীক বলে মেনে নেন। বিপ্লবী বেইলি-কে প্যারিস পৌরসভার মেয়র পদে বসানো হয়। জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সংগঠিত করে বিপ্লবী লাফায়েৎ-কে এর প্রধান সেনাপতি করা হয়।
(২) স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে আঘাত
কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের প্রতীক। এখানে বিনা বিচারে প্রজাদের বন্দি করে রাখা হত। তাই বাস্তিলের পতনে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসে। এর ফলে রাজতন্ত্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
(৩) জনগণের শক্তিবৃদ্ধি
বাস্তিলের পতন ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। প্রবল প্রতাপশালী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে যে জয় লাভ করা সম্ভব তা বাস্তিলের পতনের ঘটনা প্রমাণ করে দেয়।
(৪) অভিজাতদের দেশত্যাগ
বাস্তিলের ঘটনার পর আতঙ্কিত বহু অভিজাত প্রাণভয়ে বিদেশে চলে যায়। অভিজাতরা উপলব্ধি করে যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া তাদের বিশেষ অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি-র মতে, “বাস্তিলের পতনের সামরিক গুরুত্ব ছিল না, তবে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল ব্যাপক।” ঐতিহাসিক গুডউইন বলেছেন যে, “বাস্তিল দুর্গের পতন শুধু ফ্রান্স নয়, সমগ্র বিশ্বে নতুন স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছিল।”
১৭। ফরাসি বিপ্লবে গ্রাম্য জনতার ভূমিকার পরিচয় দাও। অথবা, গ্রামাঞ্চলে ফরাসি বিপ্লবের প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- কয়েক বছর ধরে চলা তীব্র আর্থিক সংকট, দুর্ভিক্ষ, তীব্র খাদ্যাভাব প্রভৃতির ফলে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের দরিদ্র মানুষ ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে।
সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা করভি বা শ্রমকর, টাইদ বা ধর্মকর, টাইলে বা ভূমিকর-সহ বিভিন্ন ধরনের সামন্ততান্ত্রিক কর প্রদানে বাধ্য হত। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতন হলে সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের উন্মাদনা তীব্র হয়ে ওঠে।
মহাতঙ্ক
বাস্তিলের পতনের পর গ্রামাঞ্চলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, অভিজাতদের ভাড়াটে গুন্ডা ও রাজার সেনাদল গ্রামের কৃষকদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে। এই গুজব ‘মহাতঙ্ক’ নামে পরিচিত। মহাতঙ্কের ফলে গ্রামাঞ্চলের বিদ্রোহীরা সামন্তপ্রভু ও তাদের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে, তাদের খামারবাড়ি ও গির্জা ধ্বংস করে, ঋণপত্রগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেয়, পশুচারণভূমি দখল করে নেয়।
সামন্ততন্ত্রে আঘাত
বিদ্রোহের চাপে বহু জমিদারও তাদের সামতান্ত্রিক অধিকার ত্যাগ করেন। ৪ আগস্ট থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে আইনের মাধ্যমে বহু সামন্তকর, ভূমিদাস প্রথা, সামাজিক বিভাজন প্রভৃতির অবসান ঘটে। অন্তত ২০ হাজার অভিজাত ও যাজক দেশ ত্যাগ করেন।
পুরাতনতন্ত্রের অবসান
গ্রামাঞ্চলে ভয়ংকর বিদ্রোহের ফলে সেখানে সামন্তপ্রথা লুপ্ত হয় এবং মধ্যযুগের অবসান ঘটে। এভাবে গ্রামাঞ্চলে পুরাতনতন্ত্রের দ্রুত অবসান ঘটতে থাকে।
উপসংহার :- বিদ্রোহের চাপে ৪ আগস্ট অভিজাত সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি জাতীয় সভায় তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন যে, “গ্রামাঞ্চলের শোষিত কৃষকরা সামন্তপ্রভু ও অভিজাতদের তীব্র ঘৃণা করে।”
১৮। ফরাসি বিপ্লবের প্রসারে গুজবের প্রভাব উল্লেখ করো। অথবা, ফরাসি বিপ্লবে ‘মহাতঙ্ক’-এর বিবরণ দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে শোষিত ও নির্যাতিত দরিদ্র কৃষকরা সামন্তপ্রভুদের ‘করভি’ বা বেগারশ্রম-সহ বিভিন্ন সামন্তকর, রাজাকে ‘টাইলে’ বা ভূমিকর, গির্জাকে ‘টাইদ’ বা ধর্মকর প্রভৃতি দিতে বাধ্য হত। এজন্য কৃষকরা তাদের নিকটস্থ গ্রামীণ সামন্তপ্রভু ও অভিজাতদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল।
গ্রামাঞ্চলে বিদ্রোহ
টেনিস কোর্টের শপথের (২০ জুন, ১৭৮৯ খ্রি.) পর থেকে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ খাদ্যের দাবিতে প্যারিসে এসে সর্বহারা মানুষের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। প্যারিসের উত্তেজিত জনতা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে দুর্গের পতন ঘটায়।
মহাতঙ্ক
প্যারিসের উত্তাল পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কৃষকদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে রাজকীয় সেনাবাহিনী ও অভিজাতদের ভাড়াটে গুন্ডা গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। এই গুজব ‘মহাতঙ্ক’ নামে পরিচিত।
বিদ্রোহের ব্যাপকতা
মহাতঙ্কের ঘটনার পর ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে ভয়ংকর কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহী কৃষকরা জমিদার ও তাদের কর্মচারীদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে, তাদের খামারবাড়ি ও গির্জা ধ্বংস করে, ঋণপত্রগুলি পুড়িয়ে দেয় এবং পশুচারণভূমি দখল করে নেয়। বিদ্রোহের আতঙ্কে প্রায় ২০ হাজার যাজক ও অভিজাত ব্যক্তিরা ফ্রান্স ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে ‘পুরাতনতন্ত্র’ প্রায় ভেঙে পড়ে।
উপসংহার :- গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহে আতঙ্কিত হয়ে বহু সামন্তপ্রভু স্বেচ্ছায় তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগ করে। তারা ৪ আগস্ট জাতীয় সভায় সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করে।
১৯। ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণের বিবরণ দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি রাজা ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে বুর্জোয়ারা সেখানে তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশনে বসা এবং সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের দাবি জানায়। বিপদগ্রস্ত রাজা বাধ্য হয়ে তা মেনে নিলেও খুব শীঘ্রই মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যাভাব প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় শ্রেণির লোকেরা বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ
তৃতীয় শ্রেণির অন্যতম দরিদ্র নারীরা ফরাসি বিপ্লবে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়।
খাদ্যাভাব
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করে। খাদ্যের দাবিতে প্যারিসে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যের দাবিতে প্রায় ৬ হাজার মহিলা ৫ অক্টোবর প্রবল বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে মিছিল করে ভার্সাই রাজপ্রাসাদ অভিযান করে। ‘রুটি চাই’ ধ্বনিতে মিছিল মুখরিত হয়। লাফায়েৎ-এর নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ২০ হাজার সদস্য এই মিছিল অনুসরণ করে এগোতে থাকে।
রাজতন্ত্রের শবযাত্রা
আন্দোলনকারী নারীরা ৬ অক্টোবর রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের হত্যা করে এবং সমগ্র রাজপরিবারকে বন্দি করে প্যারিসে আসতে বাধ্য করে। ঐতিহাসিক রাইকার এই ঘটনাকে ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা’ বলে অভিহিত করেছেন।
বিপ্লবী নারীদের দাবি
মিছিলে যোগদানকারী বিপ্লবী নারীদের প্রধান দাবি ছিল সস্তায় রুটি সরবরাহ করা, বিপ্লবের তেরঙা পতাকার অবমাননাকারীদের শাস্তি দান করা প্রভৃতি।
উপসংহার :- রাজপরিবারকে বন্দি করে প্যারিসে আনার সময় বিদ্রোহীরা ধ্বনি তোলে যে, “আমরা রুটিওয়ালা, রুটিওয়ালার স্ত্রী ও তাদের বালক পুত্রকে পেয়েছি।” নারীদের প্যারিস অভিযান ও রাজতন্ত্রের শবযাত্রার পরবর্তী বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র ছিল প্যারিস।
২০। ফরাসি সংবিধান সভার (১৭৮৯ খ্রি.) গঠন উল্লেখ করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা সকল সম্প্রদায়ের সদস্যদের একই কক্ষে বসা এবং মাথাপিছু ভোটাধিকারের দাবি জানালে অধিবেশনে গোলমাল শুরু হয়।
প্রকৃত জাতীয় সভা
তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নিজেদের সভাকে প্রকৃত ‘জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করে এবং দাবি করে (১৭ জুন, ১৭৮৯ খ্রি.) যে, করধার্য করার অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। এরপর ২০ জুন প্রতিনিধিরা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সভাকক্ষে ঢুকতে গেলেও তা তালাবন্ধ থাকায় ঢুকতে পারেন না।
টেনিস কোর্টের শপথ
তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা নিকটবর্তী টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন যে, যতদিন না তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবেন, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন। এই ঘটনা ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ নামে পরিচিত।
সংবিধান সভা
২৭ জুন জাতীয় সভার সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের যৌথ অধিবেশন বসে। এই সভা ৯ জুলাই সংবিধান সভায় পরিণত হয়। সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনার কাজে নিয়োজিত হয়।
সংবিধান রচনা
লাফায়েৎ, মিরাবো, আবে সিয়েস, রোবসপিয়ার, মুনিয়ের, বারনেভ, তালিরাঁ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংবিধান সভা দু-বছরের চেষ্টায় (১৭৮৯-১৭৯১ খ্রি.) নতুন সংবিধান রচনা করে। এটি ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান নামে পরিচিত। এটিই ছিল ফ্রান্সের প্রথম লিখিত সংবিধান।
উপসংহার :- সংবিধান সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা ছিলেন সংখ্যালঘু। সংবিধান সভার দ্বারা সর্বপ্রথম ফ্রান্সেই সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে।
২১। সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে ফ্রান্সের সংবিধান সভা (১৭৮৯ খ্রি.) কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকে ফরাসি বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া নেতারা সামন্তপ্রভুদের অধিকার ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। এজন্য ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, “ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতক ছিল আধুনিক যুগের সুতিকাগার।”
সংবিধান সভা গঠন
ফ্রান্সের জন্য সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে সংবিধান সভা (১৭৮৯ খ্রি.) গঠিত হয়। এই সভা মূল সংবিধান রচনার আগে যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তার মধ্যে একটি ছিল সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি। তৃতীয় শ্রেণির চাপে অভিজাত ও যাজকরা ৪ আগস্ট (১৭৮৯ খ্রি.) এক ঘোষণার মাধ্যমে তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগ করে।
সামন্তকর বিলোপ
জাতীয় সভা ১১ আগস্ট এক ঘোষণার মাধ্যমে জানায় যে, “এখন থেকে সামন্তপ্রথা বিলুপ্ত হল”। সামন্তপ্রভুরা তৃতীয় শ্রেণির দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে করভি (শ্রমকর)-সহ বিভিন্ন ধরনের সামন্তকর এবং গির্জা ‘টাইদ’ (ধর্মকর) আদায় করত। সংবিধান সভা এইসব সামন্ততান্ত্রিক কর বিলোপ করে।
সামন্তদের অধিকার বিলোপ
সামন্ত ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের বিলোপ ঘটানো হয়। ভূমিদাস প্রথা, সামন্তপ্রভুদের বংশকৌলিন্যের অধিকার, খেতাব, জমিদারি, স্বত্ত্ব, একেচেটিয়া সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি প্রথার অবসান ঘোষণা করা হয়। রাজার খাস জমি ও গির্জার জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
গুরুত্ব
সংবিধান সভা আপাতত সামন্ততন্ত্রের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটাতে ব্যর্থ হলেও এই সভার ঘোষণাগুলি সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। নর্মান হ্যাম্পসন মনে করেন যে, জাতীয় সভা অনেকটা এগোলেও সম্পূর্ণ পথ যেতে পারে নি।
উপসংহার :- ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি, ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ঘোষণা।
২২। টীকা লেখো : ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা। অথবা, টীকা লেখো : নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের ঘোষণা।
উত্তর:- ভূমিকা :- ২৬ আগস্ট, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সংবিধান সভা মূল সংবিধান রচনার আগে ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা’ নামে একটি দলিল প্রকাশ করে।
ঘোষণাপত্রের ভিত্তি
ফরাসি সংবিধান সভা কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্র রচনার ক্ষেত্রে ‘আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং ইংল্যান্ডের ‘ম্যাগনা কার্টা’ ও ‘বিল অব রাইট্স’, লক, রুশো, মন্তেস্কু প্রমুখ দার্শনিকের মতাদর্শ প্রভৃতির বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মানুষের অধিকার ঘোষণা
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে, (ক) মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত ও স্বাধীন, (খ) মানুষের জন্মগত অধিকারগুলি পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়, (গ) আইনের চোখে সকল মানুষ সমান, (ঘ) রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ, (ঙ) যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অধিকারী, (চ) বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি হল মানুষের সর্বজনীন অধিকার।
সীমাবদ্ধতা
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন – (ক) ঘোষণাপত্রে সামাজিক সাম্যের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি। (খ) এতে মানুষের অর্থনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। (গ) এতে শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। (ঘ) মানুষের সংগঠিত আন্দোলন করার অধিকার সম্পর্কেও ঘোষণাপত্রটি নীরব থেকেছে। (ঙ) নাগরিকের অধিকারের কথা বলা হলেও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ঘোষণাপত্রে কিছুই বলা হয় নি।
গুরুত্ব
কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের গুরুত্বকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক ওলার বলেছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে “বিশেষ অধিকার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার ও সাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” তিনি এই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রকে ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু-পরোয়ানা বলে অভিহিত করেছেন। কোবান মনে করেন যে, এই ঘোষণাপত্র “বিশেষ অধিকারের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছে।”
উপসংহার :- ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রে দার্শনিক তত্ত্বের তুলনায় ‘স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের’ বেশি প্রভাব পড়েছে। এই ঘোষণায় শুধু ফ্রান্স নয়, বিশ্বে মানবজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
২৩। ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- মূল সংবিধান রচনার আগে ফরাসি সংবিধান সভা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার’ ঘোষণা করে। এই ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
স্বাধীনতার স্বীকৃতি
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ফরাসি তথা বিশ্বমানবতার অধিকার ঘোষণা করে। এই অধিকারপত্র ঘোষণা করে যে, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এর দ্বাবা ফ্রান্সের মানুষ বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় ও ভোগের অধিকার প্রভৃতি লাভ করে।
পুরাতনতন্ত্রের ধ্বংস
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ফ্রান্সের পচনশীল পুরাতনতন্ত্র, স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র, যাজকতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র প্রভৃতির পতন ঘোষণা করে। ঐতিহাসিক ওলার এই ঘোষণাপত্রটিকে ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু-পরোয়ানা’ বলে অভিহিত করেছেন।
জনগণের সার্বভৌমত্ব
ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র প্রমাণ করে যে, স্বৈরাচারী ও দৈব ক্ষমতার দাবিদার রাজা নন, দেশের জনগণই হল প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ঐতিহাসিক লেফেভর বলেছেন যে, “এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের কালজয়ী আবেদনের সূত্রপাত ঘটে।”
আন্তর্জাতিক প্রভাব
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্র ফ্রান্সের বাইরে বিভিন্ন দেশের মানুষকেও মুক্তির পথ দেখায়। ইউরোপের বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মনে এই ঘোষণাপত্র নতুন আশার আলো সঞ্চার করে। তাই ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন যে, এই ঘোষণাপত্রটি “নেপোলিয়নের সমগ্র বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী ছিল।”
উপসংহার :- ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন যে, “ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ছিল পুরাতনতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক।”
২৪। ফ্রান্সের নতুন আইনসভা (১৭৯১ খ্রি.) সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান অনুসারে ফ্রান্সের মাত্র ৫০ হাজার ‘সক্রিয়’ নাগরিকের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এক-কক্ষবিশিষ্ট নতুন আইনসভা গঠিত (১৭৯১ খ্রি.) হয়। এর সদস্যসংখ্যা ছিল ৭৪৫ জন। এই সদস্যরা দু-বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। সদস্যরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারতেন না।
দায়িত্ব
নতুন আইনসভা ছিল ফ্রান্সের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সমগ্র দেশের জন্য আইন প্রণয়ন, বিদেশনীতি পরিচালনা, অর্থ বরাদ্দ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব ছিল এই আইনসভার হাতে।
রাজার ভূমিকা
আইনসভা প্রণীত কোনো আইন বাতিল করা বা আইনসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাজার ছিল না। তবে তিনি ‘ভিটো’ প্রয়োগের মাধ্যমে এই আইনকে কিছুকালের জন্য স্থগিত রাখতে পারতেন। আইনসভায় কোনো আইন পরপর তিনবার পাশ হয়ে গেলে তা রাজার সম্মতি ছাড়াই আইনে পরিণত হত।
জটিলতা
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর নতুন আইনসভার প্রথম অধিবেশন বসে। প্রথম থেকেই এই আইনসভা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই আইনসভার সকল সদস্যই ছিলেন নতুন ও অনভিজ্ঞ। রাজতন্ত্র-বিরোধী জনগণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হলেও নতুন আইনসভা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল না।
উপসংহার :- নতুন সংবিধান আইনসভার পাশাপাশি রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চাইলেও রাজা এই বিপ্লবী সংবিধান মানতে রাজি ছিলেন না। ফলে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
২৫। স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার অধিবেশন নিয়ে রাজার সঙ্গে জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিনদের বিরোধের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই গোপনে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েন করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে রাজার সঙ্গে জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন দলের সমর্থকদের বিরোধ শুরু হয়।
নতুন আইন
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের নতুন আইনসভায় জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন দলের সদস্যরা রাজ-বিরোধী দুটি আইন পাশ করে। এই আইনে বলা হয় যে, (ক) যাজকদের নতুন করে ‘ধর্মযাজকদের সংবিধান’-এর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে। (খ) এমিগ্রি অর্থাৎ দেশত্যাগী অভিজাতরা দু-মাসের মধ্যে দেশে না ফিরলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে এবং দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব
রাজা ষোড়শ লুই উক্ত আইন দুটিতে ‘ভিটো’ প্রয়োগ করে অর্থাৎ অনুমোদন না দিয়ে স্থগিত করে দেন। ফলে জ্যাকোবিন দলের নেতৃত্বে উত্তেজিত জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ (১০ আগস্ট, ১৭৯২ খ্রি.) করে রাজার দেহরক্ষীদের হত্যা করে। অবশেষে আইনসভা রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁকে টেম্পল দুর্গে বন্দি করে। ঐতিহাসিক লেফেভর এই ঘটনাকে ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।
সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড
রাজা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর উভয় দল রাজার সমর্থক সন্দেহ করে বহু মানুষকে বন্দি করে এবং জেলে ঢুকে চারদিন ধরে (২-৫ সেপ্টেম্বর, ১৭৯২ খ্রি.) হাজার হাজার বন্দিকে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত।
উপসংহার :- রাজতন্ত্রের উচ্ছেদের পর উভয় দল ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এটি ছিল ফ্রান্সের প্রথম প্রজাতন্ত্র। কিছুদিনের মধ্যে জ্যাকোবিন দল বিচারের নামে প্রহসন করে রাজা যোড়শ লুইকে মৃত্যুদণ্ড (২১ জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রি.) দেয়।
২৬। ফ্রান্সের নতুন আইনসভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত সংবিধানের ভিত্তিতে ফ্রান্সে ‘সক্রিয়’ নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে নতুন আইনসভা গঠিত হয়। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর ৭৪৫ জন সদস্য ও এক-কক্ষবিশিষ্ট এই আইনসভার প্রথম অধিবেশন বসে। এই আইনসভায় প্রধানত চারটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল।
দক্ষিণপন্থী শাসনতান্ত্রিক দল
‘ফিউল্যান্ট’ নামে পরিচিত এই দক্ষিণপন্থী দল আইনসভার স্পিকারের ডান অর্থাৎ দক্ষিণদিকে বসত। এই দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ২৬৪ জন। রাজতন্ত্র, অভিজাত সম্প্রদায় ও যাজকদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বিপ্লব-বিরোধী এই দল দেশত্যাগী অভিজাতদের ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মযাজকদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াকে সমর্থন করত।
জিরন্ডিস্ট দল
ব্রিসো-এর নেতৃত্বাধীন বামপন্থী জিরন্ডিস্ট দল স্পিকারের বামদিকে বসত। ডুমারিয়েজ, কুঁত, কন্দরসে প্রমুখ ছিলেন এই দলের অন্যতম নেতা। গ্রামাঞ্চলে এই দলের ব্যাপক প্রভাব ছিল।
জ্যাকোবিন দল
উগ্র বামপন্থী জ্যাকোবিন দল ছিল রাজতন্ত্র বিরোধী এবং প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। এই দলের সদস্যরা স্পিকারের বামদিকে বসত। এই দলের ১৩৬ জন সদস্য ছিল। সারা দেশে প্রায় ২০০০ শাখা এই দলের সংগঠনকে মজবুত করে তুলেছিল। এই দলের অন্যতম নেতা ছিলেন রোবসপিয়ার, দাঁতো, ম্যারাট প্রমুখ। কারিগর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিম্ন বুর্জোয়ারা ছিলেন এই দলের প্রধান সমর্থক।
মধ্যপন্থী দল
মধ্যপন্থী দল ছিল নিরপেক্ষ। অর্থাৎ, এই দলের সদস্যরা কোনো দল বা মতের সমর্থক ছিল না। এই দলের সদস্যরা আইনসভার মাঝখানে বসত এবং বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করত।
উপসংহার :- আধুনিক বিশ্বরাজনীতিতে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী বলতে যা বোঝায় সেই ধারণা ফরাসি আইনসভার সদস্যদের আসন গ্রহণের পদ্ধতি থেকে প্রাপ্ত।
২৭। কীভাবে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই-এর মৃত্যুদণ্ড হয়?
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই-এর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে জিরন্ডিস্ট দলের নেতৃত্বে প্রায় ৮ হাজার সশস্ত্র মানুষের বিশাল মিছিল টুইলারিজ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে (২০ জুন, ১৭৯২ খ্রি.)।
ব্রান্সউইক ঘোষণা
এই সময় প্রাশিয়ার সেনাধ্যক্ষ ডিউক অব ব্রান্সউইক এক ঘোষণার মাধ্যমে ফরাসি জাতিকে সতর্ক করে বলেন, ফরাসি রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি কেউ করলে তিনি তাদের চরম শাস্তি দেবেন।
রাজতন্ত্রের অবসানের দাবি
ব্রান্সউইক ঘোষণার ফলে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা সন্দেহ করে যে, রাজপরিবার বিদেশিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দেশে বিপ্লবীদের ধ্বংস করতে চাইছে। ফলে উন্মত্ত জনতা ১০ আগস্ট (১৭৯২ খ্রি.) দ্বিতীয়বার রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে প্রায় ৮০০ রক্ষীকে হত্যা করে। আতঙ্কিত রাজপরিবার নিকটবর্তী আইনসভা কক্ষে আশ্রয় নিলে জনতা আইনসভা অভিযান করে রাজতন্ত্রের অবসানের দাবি জানায়।
রাজার বিচার
উন্মত্ত জনতার চাপে আইনসভা রাজাকে বরখাস্ত করে তাঁর বিচারের উদ্দেশ্যে টেম্পল দুর্গে বন্দি করে। রাজার বিচারকে কেন্দ্র করে জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন দলের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। জিরন্ডিস্ট দল রাজার মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে গণভোটের ভিত্তিতে রাজার অন্য-কোনো শাস্তিদানের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু উগ্র বামপন্থী জ্যাকোবিন দল রাজার মৃত্যুদণ্ডের জোরালো দাবি জানায়।
মৃত্যুদণ্ড
শেষপর্যন্ত জাতীয় সভা সামান্য ভোটের ব্যবধানে রাজার মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি গিলোটিনে রাজা ষোড়শ লুই-এর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। রাজার মৃত্যুদণ্ড ইউরোপকে স্তম্ভিত করে। ঐতিহাসিক হ্যাজেন বলেছেন, “সিংহাসনের তুলনায় রাজা ফাঁসির মঞ্চে বেশি মহান ছিলেন।”
উপসংহার :- জ্যাকোবিন নেতা রোবসপিয়ার বলেন যে, “রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে রাজাকে মরতেই হবে।” ষোড়শ লুই-এর মৃত্যুদণ্ডের পর আতঙ্কিত ইউরোপে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিজোট গড়ে ওঠে।
২৮। ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কতটা সক্রিয় হয়েছিল?
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের ব্যাপকতা এবং আধুনিক ভাবধারা ইউরোপের রাজতন্ত্রগুলিকে আতঙ্কিত করে। অস্ট্রিয়া, সার্ডিনিয়া, স্পেন ও নেপলসের রাজপরিবারের সঙ্গে ফরাসি রাজপরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। ফলে এই সব ইউরোপীয় শক্তি ফ্রান্সের অভ্যন্তরে বিপ্লবী শক্তির অগ্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ফিলিপ গুয়েদালা বলেছেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল ফ্রান্সের বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে রাজতন্ত্রী শক্তিগুলির লড়াই।”
পাদুয়ার ঘোষণা
ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই-এর শ্যালক অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ড পাদুয়া নামক স্থানে এক ঘোষণা জারি করে (৬ জুলাই, ১৭৯১ খ্রি.) ফরাসি রাজতন্ত্রের সমর্থনে ইউরোপীয় রাজাদের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ডাক দেন। এটি পাদুয়ার ঘোষণা নামে পরিচিত।
পিলনিৎজের ঘোষণা
অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ড এবং প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ উইলিয়াম পিলনিজ-এ এক বৈঠকে মিলিত হয়ে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ (২০ আগস্ট, ১৭৯১ খ্রি.) করেন। এর দ্বারা তাঁরা ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে ফরাসি রাজতন্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। এটি পিলনিৎজের ঘোষণা নামে পরিচিত।
ব্রান্সউইক ঘোষণা
প্রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি ডিউক অব ব্রান্সউইক এক ঘোষণায় (আগস্ট, ১৭৯২ খ্রি.) বলেন যে, কেউ ফরাসি রাজপরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে তিনি তাদের চরম শাস্তি দেবেন। এটি ব্রান্সউইক ঘোষণা বা ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টো নামে পরিচিত।
যুদ্ধ
বিভিন্ন বিদেশি শক্তি ফরাসি রাজার সমর্থনে ফ্রান্স আক্রমণ করে। চূড়ান্ত যুদ্ধে বিপ্লবী ফ্রান্স সাফল্যের সঙ্গে জয় লাভ করে। ভামির যুদ্ধে (১৭৯২ খ্রি.) অস্ট্রো-প্রাশিয়া বাহিনী ফরাসি বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে আপাতত বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা থেকে বিপ্লবী ফ্রান্স মুক্ত হয়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, “যুদ্ধের ফলে ফ্রান্স একই সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের প্রচারক এবং পররাজ্য অপহরণকারী দস্যু-উভয় ভূমিকা পালন করে।”
২৯। জ্যাকোবিন শাসনের পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্সের উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল ছিল জ্যাকোবিন দল। এই দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রোবসপিয়ার, দাঁতোঁ, ম্যারাট প্রমুখ।
জ্যাকোবিন দলের আদর্শ
জ্যাকোবিন দল সম্পত্তির ভিত্তিতে নাগরিকের ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এই দলের মূল লক্ষ্য ছিল। জ্যাকোবিনরা রুশোর সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে এই দলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল।
জিরন্ডিস্টদের বিতাড়ন
জ্যাকোবিনরা প্যারিসের সর্বহারা জনতার সহায়তায় আইনসভা থেকে জিরন্ডিস্টদের বিতাড়িত করে এবং শাসনব্যবস্থায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়।
সন্ত্রাসের শাসন
দেশের সংকটকালে জ্যাকোবিন দলের নেতৃত্বে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয়। তারা বিপ্লবী ফ্রান্সকে রক্ষার নামে নির্বিচারে বহু মানুষকে হত্যা করে। রাজপরিবারের প্রায় সকলকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। জ্যাকোবিন নেতা হিবার্ট বলেন, “নিরাপত্তার প্রয়োজনে সকলকে হত্যা করতে হবে।” জ্যাকোবিন দল তিনটি সংস্থার সহায়তায় দেশে স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যথা – জ্যাকোবিন ক্লাব, বিপ্লবী কমিউন ও কনভেনশন কমিটি।
জনকল্যাণ
সন্ত্রাসের শাসনকালে জ্যাকোবিন দল বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেয়। (ক) মজুতদারি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। (খ) নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সর্বোচ্চ মূল্য এবং মজুরির সর্বনিম্ন হার বেঁধে দেওয়া হয়। (গ) দাসপ্রথার অবসান ঘটানো হয়। (ঘ) অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের বণ্টন করা হয়। (ঙ) অবৈতনিক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। (চ) খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি বাতিল করে ‘প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি’ চালু করা হয়।
উপসংহার :- জাতীয় সভার আতঙ্কিত সদস্যরা রোবসপিয়ারকে মৃত্যুদণ্ড দিলে (২৮ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রি.) ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে।
৩০। মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের সঙ্গে জ্যাকোবিন ক্লাবের সম্পর্ক আলোচনা করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে দাক্ষিণাত্যের মহীশূরে হায়দার আলি এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। পরে হায়দারের পুত্র টিপু সুলতান এই রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান।
ফ্রান্সের সহায়তা প্রার্থনা
ইংরেজদের হাত থেকে মহীশূরের স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে টিপু সুলতান বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিজ শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি ফ্রান্সের বিপ্লবী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা সফল হয়ে ওঠে নি।
‘স্বাধীনতার বৃক্ষ’ রোপণ
টিপু সুলতান নিজে স্বৈরাচারী শাসক হলেও ফ্রান্সের জ্যাকোবিন দলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকারের প্রতি তিনি বিশেষ অনুরাগ দেখান। তিনি ফরাসি বিপ্লব ও ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে ‘স্বাধীনতার বৃক্ষ’ বা ‘Tree of Liberty’ রোপণ করেন।
জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য
টিপু সুলতান ফ্রান্সের উগ্র বামপন্থী জ্যাকোবিন ক্লাবের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি নিজে জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাজধানীতে জ্যাকোবিন পন্থীদের আগমন প্রার্থনা করেন।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
সুদূর ফ্রান্সের বিপ্লব ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি টিপু সুলতানের সমর্থন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচয় দেয়।
উপসংহার :- টিপু সুলতান অষ্টাদশ শতকে দূর বিশ্বের সঙ্গে যে রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালান তা সে যুগে অন্য-কোনো ভারতীয় শাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
৩১। ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ কী?
উত্তর:- ভূমিকা :- ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ফ্রান্সে এক আপৎকালীন জরুরি শাসনব্যবস্থা চালু ছিল যা সন্ত্রাসের শাসন নামে পরিচিত। এই শাসনের প্রধান পরিচালক ছিলেন বিপ্লবী নেতা রোবসপিয়ার।
লাল সন্ত্রাস
রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৩ মাস ফ্রান্সে প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ মানুষকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে বন্দি করা হয়, বহু মানুষ চিরদিনের মতো নিখোঁজ হয়ে যায়। মেরি আঁতোয়ানেত, মাদাম রোলাঁ, ব্রিসো, বারনাভ, বেইলি, হিবার্ট, দাঁতো প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিও সন্ত্রাসের বলি হন। সন্ত্রাসের এই হত্যালীলা ‘লাল সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত।
রোবসপিয়ারের মৃত্যু
সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত হয়ে জিরন্ডিস্ট, জ্যাকোবিন ও অন্যান্য দলের সদস্যরা রোবসপিয়ার ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে (২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রি.) পরের দিন রোবসপিয়ার-সহ তাঁর ২৪ জন অনুগামীকে গিলোটিনে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ নামে পরিচিত।
প্রতিক্রিয়া
থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়ায় (ক) জ্যাকোবিন দলের পরিবর্তে জিরন্ডিস্ট ও মধ্যপন্থী দলের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। (খ) জ্যাকোবিন ক্লাব ও বিপ্লবী সংগঠনগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। (গ) সব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাতিল করা হয়। (ঘ) ৮০ হাজার বন্দিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। (ঙ) প্যারিস কমিউন ভেঙে দিয়ে কমিউনের ৯০ জন বিপ্লবীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। (চ) দেশত্যাগীদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। (ছ) ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
উপসংহার :- ফ্রান্সের বিপ্লবী বর্ষপঞ্জী অনুসারে ৯ ধার্মিডোর (২৭ সেপ্টেম্বর) তারিখে রোবসপিয়ারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল বলে এটি ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ হল একটি প্রতিবিপ্লব।
৩২। নতুন ফরাসি সংবিধান (১৭৯৫ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
উত্তর:- ভূমিকা :- রোবসপিয়ারের মৃত্যুদণ্ডের পর জ্যাকোবিনদের পতন ঘটে এবং জিরন্ডিস্ট ও মধ্যপন্থী দল ক্ষমতা লাভ করে। ফলে শাসনতন্ত্রে বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্তদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিবিপ্লব
জিরন্ডিস্ট দলের শাসনকালে প্রতিবিপ্লব প্রকাণ্ড রূপ নেয়। মৃত রাজা ষোড়শ লুই-এর ভাই অষ্টাদশ লুই ভেরোনা থেকে এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ফ্রান্সে আগেকার রাজতন্ত্র ও ‘পুরাতনতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনার কথা ঘোষণা করেন।
সংবিধান প্রণয়ন
ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের ফিরে আসার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ দূর করতে জাতীয় কনভেনশন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে দ্রুত একটি সংবিধান চালু করে। বুর্জোয়া শ্রেণির মুখপাত্র বয়েসি দ্য অ্যাংলাস এই সংবিধান রচনা করেন।
সাংবিধানিক পদক্ষেপ
১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের দ্বারা (ক) নাগরিকদের অধিকার ঘোষাণার পাশাপাশি তাদের কর্তব্যের কথা ঘোষণা, (খ) সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের পরিবর্তে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার, (গ) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন, (ঘ) শাসনকার্য পরিচালনার জন্য পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদের একটি ‘ডাইরেক্টরি’ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বিদ্রোহ প্রতিরোধ
জাতীয় কনভেনশন প্রবর্তিত ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান অভিজাত, রাজতন্ত্রী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, প্যারিসের জনতা-কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তারা কনভেনশনের অধিবেশনে অভিযান চালালে সেনাপতি নেপোলিয়ন সহজেই বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ফ্রান্সে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণি আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে।
উপসংহার :- ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তৃতীয় বর্ষে চালু হয় বলে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত সংবিধান ‘তৃতীয় বর্ষের সংবিধান’ নামে পরিচিত। নতুন সংবিধান অনুসারে আইনসভার দুটি কক্ষ ছিল ‘বর্ষীয়ানদের সভা’ এবং ‘পাঁচশতের পরিষদ’।
৩৩। ফ্রান্সে ‘ডাইরেক্টরির শাসনকাল’ (১৭৯৫-৯৯) সম্পর্কে কী জান?
উত্তর:- ভূমিকা :- সন্ত্রাসের রাজত্বের পরে ফ্রান্সে জ্যাকোবিন দলের আধিপত্য ধ্বংস হয় এবং মধ্যপন্থী বুর্জোয়া শ্রেণি ফ্রান্সে পুনরায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই সময় ফ্রান্সে ‘ডাইরেক্টরির শাসন’ (১৭৯৫-‘৯৯ খ্রি.) নামে বিশেষ একধরনের শাসন শুরু হয়।
ডাইরেক্টরির শাসনের সূচনা
১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান অনুসারে ৫ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘ডাইরেক্টরির’ হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, (ক) ডাইরেক্টরির সদস্যদের বয়স হবে কমপক্ষে ৪০ বছর। (খ) তাঁরা আইনসভা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। (গ) তাঁদের কার্যকালের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। (ঘ) প্রতি বছর একজন করে ডাইরেক্টর পদত্যাগ করবেন এবং তাঁর স্থলে নতুন একজন ডাইরেক্টর নিযুক্ত হবেন।
বাসকুল নীতি
প্রথমে যে পাঁচজন ডাইরেক্টর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বারাস, লা র্যাভেলিয়ে, লার্জুনায়েব, রিউবেল ও কারনো। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন অপদার্থ শাসক। এই শাসকরা প্রথম থেকেই বামপন্থী জ্যাকোবিন এবং দক্ষিণপন্থী রাজতন্ত্রী দলের বিরোধিতার মুখে পড়ে। ফলে তারা উভয় দলের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার নীতি গ্রহণ করেন। এটি ‘বাসকুল নীতি’ নামে পরিচিত।
ক্ষমতা
দেশীয় শাসন পরিচালনা, স্থানীয় শাসন, সেনাবাহিনী পরিচালনা, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে ডাইরেক্টরির শাসকদের একক ক্ষমতা ছিল। তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের মতো আচরণ না করে প্রায় রাজতন্ত্র পরিচালনার মতো আচরণ করতেন। আইন প্রণয়ন বা আইন-সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষমতা ডাইরেক্টরির শাসকদের ছিল না।
পতন
ডাইরেক্টরির শাসনকাল ছিল ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকাল। এই শাসনকালে দেশে অনাচার, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু হয়। এই সুযোগে ডাইরেক্টরদের বিতাড়িত করে সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ‘কনসুলেট’ এর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার :- ডাইরেক্টরদের শাসনের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রী, বামপন্থী প্রভৃতি সকলেই বিদ্রোহ শুরু করে। তবে সবচেয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক ফ্রাঁসোয়া বেবিউফ। ডাইরেক্টরির শাসনকে ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন ‘বিপ্লবের শেষ অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।
৩৪। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব উল্লেখ করো।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রমাণ হয়, জনগণই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত উৎস। বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের জন্য সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ ইউরোপে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়।
সাম্য
ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, জনগণের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা ছিল ফরাসি বিপ্লবের লক্ষ্য। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান ফরাসি যাজক ও অভিজাতদের ‘বিশেষ অধিকার’, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বাতিল করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। বংশপরিচয় বা জন্মকৌলিন্য নয়, মানুষের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার মাপকাঠি হয় যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা। রাজপদ বিক্রি, বিচারের নামে প্রহসন প্রভৃতির অবসান ঘটানো হয়।
মৈত্রী
‘মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ নেই, একই আদর্শে অনুপ্রাণিত সব মানুষ ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ’ – ফরাসি বিপ্লব সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির সামনে এই সুমহান মৈত্রীর আদর্শ তুলে ধরে। এই মৈত্রীর সূত্র ধরেই ফরাসি জাতি স্বৈরাচারী ফরাসি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়। ফলে তাদের মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়।
স্বাধীনতা
ফরাসি বিপ্লব মানুষের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। এই মহান বিপ্লব বিশ্ববাসীর সামনে ঘোষণা করে যে, “স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার”। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি সংবিধান এই ঘোষণারই প্রতিফলন। এই সংবিধান মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, সভাসমিতি গঠনের অধিকার প্রভৃতি প্রদান করে।
উপসংহার :- সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর (Class 9 History Forashi Biplober Koyekti Dik Question and Answer)
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় MCQ প্রশ্ন উত্তর (সঠিক বিকল্প নির্বাচন)
- নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় হতে MCQ প্রশ্ন উত্তর
- নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় হতে সঠিক বিকল্প বক্তব্য নির্বাচন
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় SAQ প্রশ্ন উত্তর (অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর)
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ভুল বা ঠিক নির্ধারণ প্রশ্ন উত্তর
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় স্তম্ভ মেলাও প্রশ্ন উত্তর
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় শূন্যস্থান পূরণ প্রশ্ন উত্তর
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় বড় প্রশ্ন উত্তর
- ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণগুলি আলোচনা করো।
- ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) ফলাফল বা প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।
- সন্ত্রাসের শাসনের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো। বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের মূল্যায়ন করো। অথবা, সন্ত্রাসের শাসনের গুরুত্ব কী ছিল? সন্ত্রাসের রাজত্বকে কি সমর্থন করা যায়?
- বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
- ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা বা অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
- ফরাসি বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের ভূমিকার মূল্যায়ন করো। অথবা, ফরাসি দার্শনিকদের ভূমিকার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
- ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণগুলি আলোচনা করো।
- ফরাসি সংবিধান সভার (১৭৮৯ খ্রি.) কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
- ফ্রান্সের নতুন আইনসভার (১৭৯১-১৭৯২ খ্রি.) পরিচয় দাও।
- ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন চালু হওয়ার কারণ কী ছিল? সন্ত্রাসের শাসনের সংগঠন সম্পর্কে আলোচনা করো।
- ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন পরিচালনা সম্পর্কে আলোচনা করো। সন্ত্রাসের শাসনের বিভিন্ন কৃতিত্ব বা সাফল্যগুলি উল্লেখ করো।