নবম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় হতে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর। নবম শ্রেণী (দ্বিতীয় অধ্যায়) বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর। Class 9 History Chapter 2 Analytical (MARKS-4) Question Answer in Bengali.
নবম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় হতে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর (বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ)
নবম শ্রেণী (দ্বিতীয় অধ্যায়) বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর
শ্রেণী | নবম |
অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় |
Question Type | বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর |
Marks | 1 |
নবম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর
১। নেপোলিয়নের উত্থান ও ক্ষমতালাভ সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকা :- আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়ক যিনি এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজ প্রতিভার গুণে ফ্রান্সের শাসনক্ষমতা দখল করেন।
নেপোলিয়নের উত্থান :- নেপোলিয়ন মাত্র ১৭ বছর বয়সে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন। এই সময় ইংরেজ বাহিনীর অবরোধ থেকে ফ্রান্সের তুলোঁ বন্দর মুক্ত (১৭৯৩ খ্রি.) করে সামরিক সাফল্য দেখিয়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদে উন্নীত হন। তিনি উন্মত্ত জনতার আক্রমণ থেকে ফরাসি জাতীয় সভাকে রক্ষা (১৭৯৫ খ্রি.) করেন এবং ফলস্বরূপ মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন।
সামরিক সাফল্য :- ডাইরেক্টরির শাসনকালে (১৭৯৫- ‘৯৯ খ্রি.) নেপোলিয়ন ইতালির সার্ডিনিয়া, পার্মা, মডেনা ও নেপলসকে পরাজিত করেন। অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে মিলান দখল করেন এবং পরে অস্ট্রিয়াকে ক্যাম্পো-ফর্মিও-এর সন্ধি (১৭৯৭ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। পোপের রাজ্য আক্রমণ করে পোপকে টলেন্টিনা-এর সন্ধি (১৭৯৭ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পিরামিডের যুদ্ধে (১৭৯৮ খ্রি.) জয় লাভ করলেও নীলনদের যুদ্ধে (১৭৯৮ খ্রি.) পরাজিত হন।
ক্ষমতা দখল :- ডাইরেক্টরির শাসনকালে শাসনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে নেপোলিয়ন সেনাবাহিনীর সহায়তায় ডাইরেক্টরির শাসকদের পদচ্যুত করে (১৭৯৯ খ্রি.) ফ্রান্সে ‘কনসুলেটের’ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে ১০ বছরের জন্য এবং পরে সংবিধান সংশোধন করে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে আজীবন কনসাল পদ লাভ করেন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সম্রাট’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক ফিলিপ গুয়েদালা বলেছেন যে, “নেপোলিয়নের উত্থানের ফলে ফ্রান্সের ইতিহাস হয় ইউরোপের ইতিহাস এবং নেপোলিয়নের ইতিহাস হয় ফ্রান্সের ইতিহাস।
২। ফ্রান্সের ক্ষমতা দখলে নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণগুলি উল্লেখ করো।
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ডাইরেক্টরির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘কনসাল’ হিসেবে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল এবং ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সম্রাট’ উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং ফ্রান্সের সমকালীন পরিস্থিতি তাঁর সাফল্যে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। ফ্রান্সের ক্ষমতা দখলে নেপোলিয়নের সাফল্যের পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিল।
নেপোলিয়নের গুণাবলি :- নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত গুণাবলি, চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব ও বাকপটুতা, তুলোঁ বন্দর উদ্ধার, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ইটালির যুদ্ধে ধারাবাহিক জয়লাভ প্রভৃতির ফলে দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা দারুণ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক কার্লটন হেইজ বলেছেন যে, “এইসময় ফ্রান্সের সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন নেপোলিয়ন।”
বিপ্লব সম্পর্কে হতাশা :- সন্ত্রাসের শাসনকালে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হলে মানুষ বিপ্লব সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মানুষ আশা করেন যে, নেপোলিয়নের মতো শক্তিশালী সেনাপতি দেশে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দিতে পারবেন।
ডাইরেক্টরির অপশাসন :- অপদার্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ডাইরেক্টরদের আমলে (১৭৯৫-৯৯ খ্রি.) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যাভাব দেশকে তীব্র সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “বিপ্লবের দুরন্ত গতি শেষ হয়ে যাওয়ায় সাংগঠনিক ও সামরিক প্রতিভাধর সৈনিকের ক্ষমতালাভের পথ প্রশস্ত হয়।’
সুবিধাবাদ :- অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী নেপোলিয়ন একসময় জ্যাকোবিন দলের সদস্য হিসেবে এই দলের সমর্থনে প্রচারপত্র রচনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি সুযোগ বুঝে রোবসপিয়ারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দেন।
বিপ্লবী আদর্শ :- আদর্শের প্রতি নেপোলিয়নের শ্রদ্ধা, বিভিন্ন বিপ্লবী সংস্কার প্রবর্তন, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, বিরোধী দলগুলির প্রতি উদার মনোভাব প্রভৃতি জনগণকে খুবই আকৃষ্ট করে। তিনি ‘বিপ্লবের প্রতীকে’ পরিণত হন।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন যে, “আশা বিপ্লবের জন্ম দেয় এবং হতাশা নেপোলিয়নের উত্থানকে দ্রুততর করে।”
৩। নেপোলিয়নের নেতৃত্বে কনসুলেটের শাসন (১৭৯৯- ১৮০৪ খ্রি.) সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অপদার্থ ডাইরেক্টরির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সে ‘কনসুলেট’ নামে এক নতুন শাসনব্যবস্থা (১৭৯৯-১৮০৪ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
কনসাল :- সংবিধান বিশারদ আবে সিয়েস ‘কনসুলেটের সংবিধান’ রচনা করেন। এর দ্বারা তিন জন কনসাল নিয়ে গঠিত একটি শাসন পরিষদের হাতে ফ্রান্সের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। প্রথম কনসাল হিসেবে নেপোলিয়ন দেশের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হন এবং তাঁর হাতে আইন প্রণয়ন, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, সামরিক ও অসামরিক কর্মচারী নিয়োগ, যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ক্ষমতা দেওয়া হয়। অন্য দুই কনসাল আবে সিয়েস ও রজার ডুকোস ছিলেন প্রথম কনসালের সহকারী ও আজ্ঞাবাহী মাত্র।
আইনসভা :- ফরাসি আইনসভাকে চারটি কক্ষে ভাগ করা হয় – কাউন্সিল অব স্টেটস নামের কক্ষ আইনের প্রস্তাব উত্থাপন করত, ট্রাইবুনেট নামের কক্ষ উত্থাপিত আইনের প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা করত, ব্যবস্থাপক সভা নামের কক্ষ আইনের প্রস্তাবটি ভোটের মাধ্যমে পাশ করত এবং সিনেট নামের কক্ষ উক্ত আইনটির যৌক্তিকতা বিচার করে তা গ্রহণ বা বর্জন করত।
একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :- কনসুলেটের সংবিধান অনুসারে নেপোলিয়ন ১০ বছরের জন্য কনসাল হিসেবে নিযুক্ত হন, কিন্তু ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সংশোধন করে তিনি আজীবন কনসাল পদে নিযুক্ত হন। এভাবে ক্রমশ ফ্রান্সে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে একনায়কতন্ত্র ফিরে আসে।
উপসংহার :- কনসুলেটের সংবিধান দ্বারা নেপোলিয়ন ‘গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একনায়কতন্ত্র’-কে ফিরিয়ে আনেন। ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, “প্রথম কনসাল ছিলেন কনসুলেটের শাসনযন্ত্রের ইঞ্জিন ও বাষ্প।”
৪। টাকা লেখো : কনকর্ডাট বা ধর্ম-মীমাংসা চুক্তি।
ভূমিকা :- ফরাসি সংবিধান সভা ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে সিভিল কনস্টিটিউশন অব দ্য ক্লার্জি বা ধর্মযাজকদের সংবিধান নামে এক বিধানের দ্বারা ফরাসি গির্জাগুলি জাতীয়করণ করে গির্জার যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে পোপের বিরোধ বাধে।
চুক্তি স্বাক্ষর :- ফরাসি বিপ্লবকালে শাসনতন্ত্রের সঙ্গে পোপের যে বিরোধ বাধে তা পরবর্তীকালে নেপোলিয়ন দূর করার উদ্যোগ নেন। তিনি ফ্রান্সের শাসনক্ষমতা দখল করে পোপ সপ্তম পায়াসের সঙ্গে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কনকর্ডাট বা ধর্ম-মীমাংসা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির শর্তাবলি :- ধর্ম-মীমাংসা চুক্তির দ্বারা পোপ ফরাসি গির্জা ও গির্জার সম্পত্তির জাতীয়করণ মেনে নেন, ফ্রান্স রোমান ক্যাথোলিক ধর্মমত ও গির্জাকে স্বীকৃতি দেয়, স্থির হয় যে, সরকার যাজকদের নিয়োগ করবে এবং পোপ তাদের স্বীকৃতি দেবে, ফরাসি সরকার যাজকদের বেতন দেবে, যাজকদের ওপর বিশপদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
গুরুত্ব :- ধর্ম-মীমাংসা চুক্তির ফলে ক্যাথোলিক গির্জা অনেকটাই রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফ্রান্সে ধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শ গৃহীত হলে অন্য ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার সুযোগ পায় এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে পোপের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক কোবান যথার্থই বলেছেন যে, “কনকর্ডাট ছিল নেপোলিয়নের এক মহান জয়।”
৫। কোড নেপোলিয়ন সম্পর্কে কী জান?
নেপোলিয়নের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কীর্তি হল ‘কোড নেপোলিয়ন’ প্রবর্তন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোড নেপোলিয়ন প্রবর্তন করেন।
আইনসমূহ রচনা :- নেপোলিয়নের উদ্যোগে গঠিত কমিশন ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জন্য নতুন আইনসমূহ রচনা করেন। এটি ‘কোড নেপোলিয়ন’ বা ‘নেপোলিয়নের আইনসংহিতা’ নামে পরিচিত।
আইনসমূহের শ্রেণিবিভাগ :- কোড নেপোলিয়নে মোট ২২৮৭টি (মতান্তরে ২২৮১টি) আইন ছিল। এর আইনগুলি মূলত তিনভাগে বিভক্ত ছিল – দেওয়ানি আইন, ফৌজদারি আইন এবং বাণিজ্যিক আইন।
বৈশিষ্ট্য :- কোড নেপোলিয়নের দ্বারা আইনের চোখে দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়, সামন্ততান্ত্রিক অসাম্যের বিলোপ ঘটানো হয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়, ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করা হয় এবং অপরাধের শাস্তি হিসেবে জরিমানা, কারাদণ্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়।
ত্রুটি :- কোড নেপোলিয়নের বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। এতে সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস করা হয়, স্ত্রীর ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয় এবং শ্রমিকশ্রেণি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আইনসংহিতার নামকরণ করেন ‘কোড নেপোলিয়ন’। ঐতিহাসিক লেফেভর বলেছেন যে, “কোড নেপোলিয়ন সমাজের বাইবেল হয়ে উঠেছিল।”
৬। কোড নেপোলিয়ন বা নেপোলিয়নের আইনসংহিতার গুরুত্ব কী ছিল?
ভূমিকা :- সম্রাট নেপোলিয়নের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কীর্তি হল ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কোড নেপোলিয়ন’ নামে আইনসংহিতা রচনা। কোড নেপোলিয়নের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(ক) সাম্যের স্বীকৃতি :- নেপোলিয়ন তাঁর আইনসংহিতায় ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত সাম্যনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্যের অবসান, আইনের চোখে সকলের সমান মর্যাদা, সরকারি চাকরিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রভৃতির মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হন।
(খ) স্বাধীনতার স্বীকৃতি :- নেপোলিয়ন তাঁর আইনসংহিতার মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত গুরুত্বপূর্ণ ভাবধারা স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেন। বাস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় ও ভোগদখলের স্বাধীনতা প্রভৃতি ছিল কোড নেপোলিয়নে উল্লিখিত উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা।
(গ) আধুনিকতা :- কোড নেপোলিয়নের আইনসমূহ সমকালীন যুগের বিচারে অত্যন্ত আধুনিক ছিল। ফ্রান্সে প্রচলিত হওয়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আইনব্যবস্থায় এটি স্থান পায়। এই কৃতিত্বের জন্য নেপোলিয়নকে অনেকে ‘দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান’ বলে অভিহিত করেন।
(ঘ) বিপ্লব রক্ষিত :- ফরাসি বিপ্লবের মূল লক্ষ্যগুলিকে নেপোলিয়ন তাঁর আইনব্যবস্থায় স্থান দেন। ফিশারের মতে, এই আইনগুলি বিপ্লবের স্থায়ী বিজয়কে সুনিশ্চিত করে। নেপোলিয়ন নিজেও তাঁর যুদ্ধ জয়ের চেয়ে এই আইনগুলিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আইনসংহিতার নামকরণ করেন ‘কোড নেপোলিয়ন’। ঐতিহাসিক লেফেভর বলেছেন যে, “কোড নেপোলিয়ন সমাজের বাইবেল হয়ে উঠেছিল।”
৭। ট্রাফালগারের যুদ্ধের (১৮০৫ খ্রি.) কারণ উল্লেখ করো।
ভূমিকা :- অ্যামিয়েন্সের সন্ধির (১৮০২ খ্রি.) পর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং উভয়পক্ষের মধ্যে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ (১৮০৫ খ্রি.) সংঘটিত হয়। ট্রাফালগারের যুদ্ধের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(ক) অ্যামিয়েন্সের সন্ধি :- অ্যামিয়েন্সের সন্ধি-এর (১৮০২ খ্রি.) শর্তে মাল্টা দ্বীপ ইংল্যান্ডের ছাড়ার কথা থাকলেও পরে ইংল্যান্ড তা ছাড়তে অস্বীকার করে।
(খ) নজরদারি :- ইংল্যান্ড মাল্টা দ্বীপ না ছাড়ায় নেপোলিয়নও জার্মানিতে ব্রিটিশ-রাজ্যের সম্পত্তির ওপর সেনার নজরদারি শুরু করে।
(গ) ফরাসি জাহাজ আক্রমণ :- ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী বারবার ফরাসি বাণিজ্য-জাহাজগুলি আক্রমণ করতে থাকে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ভ্রমণকারী ১০০০ ইংরেজকে বন্দি করেন।
(ঘ) অপপ্রচার :- ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রগুলিতে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার চালানো হয়। ফলে নেপোলিয়ন ক্রুদ্ধ হন এবং উভয় শক্তির মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।
(ঙ) ফ্রান্সের নৌশক্তি বৃদ্ধি :- সামুদ্রিক বাণিজ্য ও নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ফ্রান্স নৌশক্তি বৃদ্ধিতে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে ইংল্যান্ড আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন ইংলিশ চ্যানেল ও উত্তর সাগরের তীরে ২ লক্ষাধিক সেনা সমাবেশ করেন। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
৮। ট্রাফালগারের যুদ্ধের (১৮০৫ খ্রি.) বিবরণ দাও।
ভূমিকা :- ফরাসি শাসক নেপোলিয়ন ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে নীলনদের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হলে ইংল্যান্ডের প্রতি তাঁর আক্রোশ সৃষ্টি হয়। এর ফলস্বরূপ ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ (১৮০৫ খ্রি.) সংঘটিত হয়।
নেপোলিয়নের যুদ্ধ-প্রস্তুতি :- ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে অ্যামিয়েন্সের সন্ধি (১৮০২ খ্রি.) ভেঙে যাওয়ার পর নেপোলিয়ন বিভিন্ন ঘটনায় ইংল্যান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি সরাসরি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ড আক্রমণের উদ্দেশ্যে ইংলিশ চ্যানেল ও উত্তর সাগরের তীরে ২ লক্ষাধিক সেনা সমাবেশ করেন।
তৃতীয় শক্তিজোট :- এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও সুইডেনকে নিয়ে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স-বিরোধী তৃতীয় শক্তিজোট গড়ে ওঠে। এই শক্তিজোট ভাঙার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন দ্রুতগতিতে অস্ট্রিয়াকে আক্রমণ করে উলমের যুদ্ধে (১৮০৫ খ্রি.) পরাজিত করেন।
ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ :- নেপোলিয়নের ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ইংরেজ নৌ-সেনাপতি নেলসন ফরাসি নৌ-সেনাপতি ভিলনেউভ-কে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে (২১ অক্টোব ১৮০৫ খ্রি.) শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। যুদ্ধে ফরাসি নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
উপসংহার :- ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ফরাসি নৌশক্তির সঙ্গে স্পেনের নৌবহরও যুক্ত ছিল। উভয় নৌবহর ইংল্যান্ডের আক্রমণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয় ছিল নেপোলিয়নের পতনের প্রথম ধাপ।
৯। ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধের (১৮০৫ খ্রি.) গুরুত্ব উল্লেখ করো।
ভূমিকা :- ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজ নৌ-সেনাপতি নেলসন ফরাসি নৌ-সেনাপতি ভিলনেউভ-কে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ট্রাফালগারের যুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(ক) ব্রিটিশ নৌবহরের শ্রেষ্ঠত্ব :- ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথ নৌবহর ধ্বংস করে। এই যুদ্ধে প্রমাণিত হয় যে, ফ্রান্সের তুলনায় ব্রিটিশ নৌবাহিনী অনেক শক্তিশালী।
(খ) নেপোলিয়নের স্বপ্নভঙ্গ :- সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়ন সুবিশাল ফরাসি সাম্রাজ্য গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ভেঙে যায়। ইংল্যান্ডকে পদানত করার বিষয়ে তাঁর স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যায়।
(গ) ফরাসি নৌবহর ধ্বংস :- ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ফরাসি নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় ভবিষ্যতে ফ্রান্সের পক্ষে ইংল্যান্ডকে প্রতিহত করার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়।
(ঘ) মর্যাদা নষ্ট :- ট্রাফালগারের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের ফলে ইউরোপে নেপোলিয়নের মর্যাদা যথেষ্ট পরিমাণে নষ্ট হয়। ইতিপূর্বে ইউরোপে যে অপরাজেয় নেপোলিয়নের ধারণা গড়ে উঠেছিল তা নিমেশে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
উপসংহার :- ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ফরাসি নৌশক্তির সঙ্গে স্পেনের নৌবহরও যুক্ত ছিল। উভয় নৌবহর ইংল্যান্ডের আক্রমণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয় ছিল নেপোলিয়নের পতনের প্রথম ধাপ।
১০। নেপোলিয়ন কর্তৃক ইউরোপের পুনর্গঠন সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকা :- ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের শাসনক্ষমতা দখল করার আগেই সেনাপতি নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান শুরু করেন। রাশিয়ার সঙ্গে টিলসিটের সন্ধির (১৮০৭ খ্রি.) দ্বারা ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়।
নেপোলিয়ন কর্তৃক ইউরোপের পুনর্গঠন :- নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি ইউরোপের পুনর্গঠনে নজর দেন। তার পুনর্গঠন কার্যের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে ইতালি ও জার্মানিতে।
(ক) পুনর্গঠনের নীতি :- নেপোলিয়ন অধিকৃত ভূখণ্ডগুলি নিয়ে ফ্রান্সের চারপাশে বিভিন্ন নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এইসব স্থানে ‘সিজালপাইন’, ‘বাটাভিয়া’ প্রভৃতি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সম্রাট’ উপাধি গ্রহণ করার পর সেগুলিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সব রাজ্যের সিংহাসনে নিজের ভাই, পুত্র ও নিকট আত্মীয়দের বসিয়ে দেন।
(খ) ইতালির পুনর্গঠন :- নেপোলিয়ন ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করে ইতালির মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান। তিনি ইতালিতে ‘সিজালপাইন’ ও ‘বাটাভিয়া’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানে প্রথমে প্রজাতন্ত্র ও পরবর্তীকালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইতালির জেনোয়া, টাসকানি ও পার্মা ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রোমের পোপের রাজ্য ফ্রান্সের একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়। দক্ষিণ ইতালিতে নেপলস রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নেপোলিয়ন সেখানকার সিংহাসনে নিজের ভাই জোসেফকে বসান।
(গ) জার্মানির পুনর্গঠন :- জার্মানিতে প্রায় ৩০০টি ছোটো ও দুর্বল রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। নেপোলিয়ন এই রাজ্যগুলি ভেঙে জার্মানিতে ৩৯টি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যগুলি নিয়ে ‘কনফেডারেশন অব দ্য রাইন’, ‘কিংডম অব ওয়েস্টফ্যালিয়া’ এবং ‘গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়ারশ’ নামে তিনটি রাজ্যমণ্ডল গঠন করা হয়।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন ইউরোপের পুনর্গঠন করলে ইতালি ও জার্মানি রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পায়। দুটি রাজ্যেই জাতীয়তাবাদ জন্মলাভ করে এবং ভবিষ্যতে ইতালি ও জার্মানির ঐক্যের পথ প্রস্তুত হয়।
১১। নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের কোন কোন ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করেন?
ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আদর্শ ছিল ‘সাম্য’, ‘মৈত্রী’ ও ‘স্বাধীনতা’। সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর শাসনকালে ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
দৈব অধিকারের বিলুপ্তি :- নেপোলিয়ন ক্ষমতালাভের পর ফরাসি রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক বা দৈব অধিকারতত্ত্বের বিলোপ ঘটান এবং সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করে গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
সাম্য :- নেপোলিয়ন তাঁর আইনসংহিতা অর্থাৎ কোড নেপোলিয়নের দ্বারা সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটান এবং ঘোষণা করেন যে, আইনের দৃষ্টিতে দেশের সকল নাগরিক সমান।
সামন্ততন্ত্রের বিলোপ :- ফ্রান্সের সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি ও করগুলি বিপ্লবের সময় বিলুপ্ত হয়। নেপোলিয়ন এগুলি আর ফিরিয়ে আনেন নি।
যোগ্যতার স্বীকৃতি :- নেপোলিয়ন বংশকৌলীন্য বাতিল করে যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেন। তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা দানের নিয়ম চালু করেন।
ধর্মনিরপেক্ষতা :- নেপোলিয়ন দেশে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন ফ্রান্সের বাইরে বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী আদর্শের প্রসার ঘটান। তাঁর সেনাদল ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর ফলে সেখানে পুরাতনতন্ত্র ধ্বংস হয়।
১২। নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের কোন্ কোন্ ভাবধারা ধ্বংস করেন?
ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আদর্শ ছিল ‘সাম্য’, ‘মৈত্রী’ ও ‘স্বাধীনতা’। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন দেশে সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করলেও স্বাধীনতার আদর্শ-সহ বিভিন্ন বৈপ্লবিক ভাবধারা ধ্বংস করেন।
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :- ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটলেও নেপোলিয়ন নিজেকে ‘সম্রাট’ হিসেবে ঘোষণা (১৮০৪ খ্রি.) করে দেশে পুনরায় চূড়ান্ত স্বৈরাচারী বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতার আদর্শ ধ্বংস :- নেপোলিয়ন প্রাদেশিক আইনসভাগুলির ক্ষমতা, মানুষের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে এবং নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন কঠোর নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা ধ্বংস করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ :- নেপোলিয়ন ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন এনে দেশে এমন শিক্ষার প্রবর্তন করেন যাতে শিক্ষার্থীরা সম্রাট ও রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত হয়। তিনি বিপ্লবী জ্যাকোবিনদের সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আদর্শ বাতিল করেন।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন বহু ক্ষেত্রেই বিপ্লবের আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন বলে টমসন ও গ্যারাট মনে করেন। ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন ভাবধারা ধ্বংস করায় ঐতিহাসিক জর্জ রুদে নেপোলিয়নকে ‘বিপ্লবের সন্তান’ বলে স্বীকার করেন নি।
১৩। ‘মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা’ বলতে কী বোঝ?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের অধীনে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী স্থলবাহিনী থাকলেও তাঁর নৌশক্তি ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেক দুর্বল ছিল।
ইংল্যান্ডের বীরত্ব :- নৌশক্তির দুর্বলতার জন্য তিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইউরোপের সকল শক্তি তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে মিত্রতা স্থাপনে বাধ্য হলেও একমাত্র ‘সমুদ্রের রানি’ ইংল্যান্ড তার দ্বীপরাষ্ট্রে বসে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রবল বীরত্ব দেখিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক অবরোধ :- ইংল্যান্ডকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করতে না পেরে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন।
ঘোষণা :- নেপোলিয়ন বার্লিন ডিক্রি, মিলান ডিক্রি, ওয়ারশ ডিক্রি, ফঁতেনব্লু ডিক্রি প্রভৃতির মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে, কোনো ব্রিটিশ জাহাজ ইউরোপের কোনো দেশের বন্দরে ঢুকতে পারবে না এবং কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্র কোনো ব্রিটিশ পণ্য আমদানি করতে পারবে না। নেপোলিয়ন কর্তৃক ঘোষিত এই অবরোধ ‘মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা’ বা ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন, ইংল্যান্ডকে পদানত করাই ছিল মহাদেশীয় অবরোধের মূল উদ্দেশ্য।”
১৪। নেপোলিয়ন কী উদ্দেশ্যে মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা করেন?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা’ নামে এক অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণার পশ্চাতে নেপোলিয়নের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। যেমন –
(ক) শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস :- নেপোলিয়ন আশা করেন যে, ইউরোপের দেশগুলিতে ইংল্যান্ডের পণ্য আমদানি বন্ধ করতে পারলে ইংল্যান্ডের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হবে।
(খ) আর্থিক দুর্দশা :- অবরোধের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস করতে পারলে ইংল্যান্ডের কলকারখানাগুলি বন্ধ হয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও নৌকর্মী বেকার হয়ে পড়বে। ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
(গ) ফ্রান্সের শিল্পায়ন :- ইউরোপের দেশগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি বন্ধ করলে সেখানে পণ্যসামগ্রীর যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা ফরাসি পণ্যের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হবে। ফলে ফ্রান্সে দ্রুত ও ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে এবং তার ফলে ফ্রান্সের অর্থনীতি মজবুত হবে।
(ঘ) মর্যাদা বৃদ্ধি :- ঐতিহাসিক কোবান মনে করেন যে, ফ্রান্সে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটিয়ে বিশ্ববাজারে ফরাসি পণ্য পৌঁছে দিয়ে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের মর্যাদা বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
(ঙ) রাজনৈতিক লক্ষ্য :- ইংল্যান্ডকে পদানত করে ফরাসি শিল্প-বাণিজ্যের দ্রুত অগ্রগতি ঘটাতে পারলে ফ্রান্সে তাঁর শাসনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে বলে নেপোলিয়ন মনে করতেন।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন, ইংল্যান্ডকে পদানত করাই ছিল মহাদেশীয় অবরোধের মূল উদ্দেশ্য।”
১৫। নেপোলিয়ন কোন কোন ডিক্রি জারি করে মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা করেন?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইউরোপের কোনো বন্দরে ব্রিটিশ জাহাজের প্রবেশ এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক ব্রিটিশ পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ শুরু করেন।
মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা :- ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ডিক্রি জারি করেন। এগুলি হল –
(ক) বার্লিন ডিক্রি :- নেপোলিয়ন বার্লিন ডিক্রি (১৮০৬ খ্রি.) জারি করে বলেন যে, ইংল্যান্ড বা তার উপনিবেশগুলির কোনো জাহাজ ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের মিত্র বা নিরপেক্ষ কোনো দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই সব দেশে কোনো ব্রিটিশ পণ্য ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই সব দেশে কোনো জাহাজে করে ব্রিটিশ পণ্য ঢুকলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
(খ) মিলান ডিক্রি :- নেপোলিয়ন মিলান ডিক্রি (১৮০৭ খ্রি.) জারি করে বলেন যে, কোনো নিরপেক্ষ বা মিত্র দেশ অবরুদ্ধ বন্দরে জাহাজ পাঠালে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। কোনো নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলে তা শত্রুদেশের জাহাজ বলে গণ্য হবে।
(গ) ওয়ারশ ও ডিক্রি :- নেপোলিয়ন ওয়ারশ ডিক্রি (১৮০৭ খ্রি.) ও জারি করে বলেন যে, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে যেসব ব্রিটিশ পণ্য বাজেয়াপ্ত হবে তাতে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযোগ করা হবে।
(ঘ) ফঁতেনব্লু ডিক্রি :- নেপোলিয়ন ফঁতেনব্লু ডিক্রি (১৮১০ খ্রি.) জারি করে বলেন যে, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে যেসব ব্রিটিশ পণ্য বাজেয়াপ্ত হবে তাতে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযোগ করা হবে।
উপসংহার :- বার্লিন ডিক্রির শর্তগুলি রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, স্পেন ও পোর্তুগাল মেনে নিতে রাজি হয়। বার্লিন, মিলান, ওয়ারশ ও ফঁতেনব্লু ডিক্রির নীতিগুলি একত্রে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
১৬। নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল? অথবা, ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ সম্পর্কে কী জান?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বার্লিন ডিক্রির (১৮০৬ খ্রি.) দ্বারা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা করলে ইংল্যান্ডও ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশগুলির বিরুদ্ধে ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ নামে পালটা অবরোধ ঘোষণা করে।
জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা :- ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশগুলির বন্দরে অন্য কোনো দেশের জাহাজ ঢুকতে পারবে না। কোনো দেশ এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে ইংল্যান্ড সেই জাহাজ ও তার মালপত্র বাজেয়াপ্ত করবে।
অনুমোদন :- কোনো নিরপেক্ষ দেশ ফ্রান্স ও তার মিত্র কোনো দেশের বন্দরে একান্তই জাহাজ পাঠাতে চাইলে সেই জাহাজকে প্রথমে ইংল্যান্ডের কোনো বন্দরে আসতে হবে। সেখানে যথার্থ ফি ও শুল্ক বাবদ অর্থ দিয়ে লাইসেন্স বা আগাম অনুমতি নিতে হবে। তবেই সেই জাহাজ ফ্রান্সের বন্দরে ঢুকতে পারবে।
ডেনমার্কের নৌবহর ধ্বংস :- ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী ক্যানিং অনুভব করেছিলেন যে, ডেনমার্কের শক্তিশালী নৌবহর দখল করে ফ্রান্স তার নৌশক্তি বাড়িয়ে ইংল্যান্ডের অবরোধ ভেঙে দিতে পারে। এজন্য ডেনমার্কের সেই নৌবহর ইংল্যান্ড আগে থেকেই ধ্বংস করে দেয়।
উপসংহার :- ইংল্যান্ডের ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ নামে অবরোধ ঘোষণার জবাবে নেপোলিয়ন ওই বছর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মিলান ডিক্রি ও ওয়ারশ ডিক্রি জারি করে।
১৭। নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করতে কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বার্লিন ডিক্রি (১৮০৬ খ্রি.), মিলান ডিক্রি (১৮০৭ খ্রি.), ওয়ারশ ডিক্রি (১৮০৭ খ্রি.) ও ফঁতেনব্লু ডিক্রি (১৮১০ খ্রি.) প্রভৃতির দ্বারা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা করেন। মহাদেশীয় অবরোধ কার্যকর করতে নেপোলিয়ন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন –
(ক) প্রাশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ায় উদ্যোগ :- নেপোলিয়নের কাছে পরাজিত হয়ে প্রাশিয়া ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে, রাশিয়া ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে এবং অস্ট্রিয়া ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মহাদেশীয় অবরোধের নীতিগুলি মেনে নেয়।
(খ) সুইডেন আক্রমণ :- সুইডেন অবরোধ ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়নের মিত্র রাশিয়া সুইডেন আক্রমণ করে মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে বাধ্য করে।
(গ) পোর্তুগাল দখল :- ইংল্যান্ডের অনুগত পোর্তুগাল মহাদেশীয় অবরোধ মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগাল দখল করে নেন।
(ঘ) স্পেন দখল :- পোর্তুগাল থেকে ফেরার পথে নেপোলিয়ন স্পেন দখল করে অবরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকরের উদ্যোগ নেন (১৮০৭ খ্রি.)।
(ঙ) পোপকে বন্দি :- রোমের শাসক পোপ নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে বন্দি করেন।
(চ) হল্যান্ড অভিযান :- হল্যান্ডের ওলন্দাজ বণিকরা নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ মানতে অস্বীকার করলে হল্যান্ড দখলের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন সেনা অভিযান পাঠান (১৮১০ খ্রি.)।
(ছ) জার্মানির উপকূল দখল :- হেলিগোল্যান্ডে ব্রিটেনের চোরা কারবার বন্ধ করতে জার্মানির বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চল নেপোলিয়ন দখল করে নেন (১৮১০ খ্রি.)।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন, ইংল্যান্ডকে পদানত করাই ছিল মহাদেশীয় অবরোধের মূল উদ্দেশ্য।”
১৮। ইংল্যান্ডে নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার কীরূপ প্রভাব পড়েছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় ব্যবস্থা নামে এক অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার লক্ষ্য ছিল ইউরোপে ব্রিটিশ পণ্যের বিক্রি বন্ধ করে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক শক্তি ভেঙে দেওয়া। ইংল্যান্ডে মহাদেশীয় ব্যবস্থার প্রভাবগুলি হল –
(ক) প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের ক্ষতি :- নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণার ফলে প্রথমদিকে ইংল্যান্ড যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইউরোপে ব্রিটিশ পণ্য বিক্রি বন্ধ হলে কারখানা বন্ধ, বেকারত্ব বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব প্রভৃতি ঘটনা ইংল্যান্ডকে প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ফেলে দেয়।
(খ) নতুন বাজার দখল :- ইংল্যান্ড কিছুদিনের মধ্যে তার প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, আটলান্টিক ও বাল্টিক উপকূল অঞ্চল প্রভৃতি এলাকায় ইংল্যান্ড নতুন বাজার দখল করে তার পণ্য বিক্রি করতে থাকলে ব্রিটিশ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
(গ) ফ্রান্সের নৌশক্তির অভাব :- নেপোলিয়নের অবরোধ সত্ত্বেও ইংল্যান্ড চোরাপথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। পর্যাপ্ত নৌশক্তির অভাবে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।
(ঘ) অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল :- মহাদেশীয় অবরোধের পালটা অস্ত্র হিসেবে ইংল্যান্ড ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ ঘোষণা করে। নিরপেক্ষ দেশগুলিকে অবাধ বাণিজ্যের লাইসেন্স বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করে।
উপসংহার :- বহু নিরপেক্ষ দেশ ফ্রান্সে জাহাজ পাঠানোর উদ্দেশ্যে ১৮০৭-১৮১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে ৪৪ হাজারেরও বেশি লাইসেন্স বা অনুমতি নেয়। তা থেকে ইংল্যান্ড প্রচুর অর্থ আদায় করে।
১৯। নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলি কী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবরোধ ঘোষণা করে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তি ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও তার উদ্দেশ্য সফল হয় নি। নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলি হল নিম্নরূপ। –
(ক) ফরাসি নৌশক্তির অভাব :- নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করলেও ইউরোপের সুবিস্তৃত উপকূল অঞ্চলে নজরদারি করে তা বাস্তবায়িত করার মতো পর্যাপ্ত নৌশক্তি ফ্রান্সের ছিল না। ফলে ইউরোপে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ আটকাতে নেপোলিয়ন ব্যর্থ হন।
(খ) ইংল্যান্ডের শক্তিশালী নৌবহর :- ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ নামে পালটা যে অবরোধ ঘোষণা করে তা ইংল্যান্ড তার শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়।
(গ) ব্রিটিশ পণ্যের চাহিদা :- ইউরোপের বাজারে উন্নতমানের বস্ত্র, চা, কফি, চিনি প্রভৃতি ব্রিটিশ শিল্পজাত সামগ্রীর খুবই চাহিদা ছিল। শিল্পে অনুন্নত ফ্রান্সের পক্ষে নিম্নমানের ও বেশি দামের পণ্য বিক্রি করে ব্রিটিশ পণ্যের চাহিদা ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না।
(ঘ) ফ্রান্সে ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি :- ফরাসি শিল্পজাত পণ্য নিম্নমানের হওয়ায় স্বয়ং ফ্রান্সকেই গোপনে ব্রিটিশ পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হত। ফরাসি চোরাকারবারিরা গোপনে ব্রিটিশ পণ্য ফ্রান্সে আমদানি করত। নেপোলিয়নও ইংল্যান্ড থেকে ফরাসি সেনাদের জন্য জুতো ও কোর্ট আমদানি করেন।
উপসংহার :- ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস করতে গিয়ে নেপোলিয়ন চতুর্দিকে অসংখ্য শত্রু তৈরি করে ফেলেন এবং শেষপর্যন্ত শত্রুদের কাঁটার জালে তিনি নিজেই আটকে পড়েন।
২০। মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা নেপোলিয়নের পতনের জন্য কতটা দায়ী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে পদানত করলেও তিনি ইংল্যান্ডকে পদানত করতে ব্যর্থ হন। এজন্য তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ জারি করে সেদেশের অর্থনীতি পঙ্গু করার পরিকল্পনা করেন।
নেপোলিয়নের পতনে মহাদেশীয় অবরোধের ভূমিকা :- নেপোলিয়ন মহাদেশীয় ব্যবস্থা বলপ্রয়োগের দ্বারা কার্যকর করতে গিয়ে বিভিন্ন সংকটে জড়িয়ে পড়েন যা তাঁর পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। যেমন –
(ক) আর্থিক ক্ষতি :- নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ‘অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল’ নামে পালটা অবরোধ ঘোষণা করে। এতে ফ্রান্সের সামুদ্রিক শিল্প-বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(খ) উপকূল দখল :- জোর করে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন ইউরোপের উপকূল অঞ্চলের বহু নিরপেক্ষ দেশের প্রায় ২ হাজার মাইল অঞ্চল দখল করে নেন। ফলে সেসব দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়।
(গ) ব্যয়ভার :- মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন সামরিক ক্ষেত্রে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তাতে দেশের আর্থিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
(ঘ) রোমে ক্ষোভ :- রোম মহাদেশীয় অবরোধ মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন রোমের শাসক পোপকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং হল্যান্ড দখল করে নেন। ফলে রোম ও হল্যান্ডবাসী ক্ষুব্ধ হয়।
(ঙ) উপদ্বীপের যুদ্ধ :- মহাদেশীয় অবরোধ কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন স্পেন ও পোর্তুগালের বিরুদ্ধে উপদ্বীপের যুদ্ধে (১৮০৮-১৪ খ্রি.) জড়িয়ে পড়েন। এই যুদ্ধে ফ্রান্স বিপর্যস্ত হয়।
(চ) রাশিয়ায় বিপর্যয় :- মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ (১৮১২ খ্রি.) করেন। কিন্তু রাশিয়ায় তাঁর গ্রাঁদ আর্মি চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়।
উপসংহার :- ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস করতে গিয়ে নেপোলিয়ন চতুর্দিকে অসংখ্য শত্রু তৈরি করে ফেলেন। শেষপর্যন্ত শত্রুদের কাঁটার জালে তিনি নিজেই আটকে পড়েন। তাই বলা যায় যে, নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা।
২১। নেপোলিয়ন কর্তৃক পোর্তুগাল অভিযানের বিবরণ দাও।
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইউরোপের দেশগুলিতে ব্রিটিশ পণ্য বিক্রি বন্ধ করতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’ নামে এক অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। এই সূত্রেই তিনি পোর্তুগাল অভিযান করেন।
ইংল্যান্ড-পোর্তুগাল সম্পর্ক :- ইংল্যান্ডের মিত্র পোর্তুগাল নেপোলিয়নের অবরোধ ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করে। কারণ, পোর্তুগাল ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
বার্লিন ডিক্রি :- নেপোলিয়ন বার্লিন ডিক্রি (১৮০৬ খ্রি.) জারি করে পোর্তুগালকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যাবতীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাতিল করে ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রী বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পোর্তুগাল এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করে।
ফঁতেনব্লু-এর সন্ধি :- নেপোলিয়ন স্পেনের সঙ্গে ফঁতেনব্লু-এর গোপন সন্ধি (১৮০৭ খ্রি.) স্বাক্ষর করে। এতে স্থির হয় যে, ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথবাহিনী পোর্তুগাল আক্রমণ ও দখল করে পোর্তুগাল ও তার উপনিবেশগুলি নিজেরা ভাগাভাগি করে নেবে।
পোর্তুগাল দখল :- ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথবাহিনী ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মার্শাল জুনো-এর নেতৃত্বে স্পেনের ওপর দিয়ে পোর্তুগাল অভিযান করে সহজেই পোর্তুগাল দখল করেন। ফলে পোর্তুগালে তাঁর মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চালু হয়।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন পোর্তুগাল অভিযানের সময় স্পেনের অনুমতি না নিয়ে স্পেনের মধ্য দিয়ে পোর্তুগালে সেনাদল পাঠান। এতে স্পেনবাসীর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে তারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
২২। নেপোলিয়নের স্পেন অভিযানের কারণ কী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা পোর্তুগাল মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন পোর্তুগাল দখল করেন এবং তারপর তিনি স্পেন দখলের পরিকল্পনা করেন।
স্পেন অভিযানের কারণ :- বিভিন্ন কারণে নেপোলিয়ন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে অভিযান পাঠান। এই কারণগুলি হল –
(ক) ‘মুক্তিদাতা’ নেপোলিয়ন :- স্পেন দখল করে সেখানে ফ্রান্সের অনুকরণে উদারনৈতিক শাসন ও বিপ্লবী সংস্কারগুলি চালু করলে স্পেনবাসী মুগ্ধ হবে এবং তাঁকে ‘মুক্তিদাতা’ বলে অভিনন্দন জানাবে বলে নেপোলিয়নের আশা ছিল।
(খ) স্পেনের আক্রমণের সম্ভাবনা :- নেপোলিয়ন গোপন সূত্র থেকে জানতে পারেন যে, স্পেনের শক্তিশালী মন্ত্রী গোদয়-এর উদ্যোগে স্পেন ও প্রাশিয়া যৌথভাবে ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এই পরিকল্পনা বানচাল করতে নেপোলিয়ন তার আগেই স্পেন আক্রমণ করেন।
(গ) স্পেনের নৌবহর :- ব্রিটিশ নৌবহরের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য নেপোলিয়ন নিজের নৌশক্তি বৃদ্ধির চিন্তায় ছিলেন। ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধের (১৮০৫ খ্রি.) সময় তিনি স্পেনের নৌবহরের শক্তি ও কার্যকারিতায় মুগ্ধ হন। এজন্য তিনি স্পেনের নৌবহর দখল করে ফরাসি নৌশক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন।
(ঘ) স্পেনবাসীর বিদ্রোহ :- নেপোলিয়ন পোর্তুগাল অভিযানের সময় স্পেনের অনুমতি না নিয়ে স্পেনের মধ্য দিয়ে পোর্তুগালে সেনাদল পাঠান। এতে স্পেনবাসীর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে তারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
উপসংহার :- ফ্রান্সের প্রাকৃতিক সীমানার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করাও নেপোলিয়ন কর্তৃক স্পেন আক্রমণের অন্যতম কারণ ছিল।
২৩। নেপোলিয়নের স্পেন অভিযানের বিবরণ দাও।
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা পোর্তুগাল মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন পোর্তুগাল দখল (১৮০৭ খ্রি.) করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্পেনে অভিযান পাঠান (১৮০৮ খ্রি.)।
স্পেন আক্রমণ :- ফরাসি বাহিনী পোর্তুগাল দখল করে সেখান থেকে ফরাসি বাহিনী ফেরার পথে হঠাৎ স্পেনের বিভিন্ন দুর্গ দখল করে নেয়। স্পেনের বুরবোঁ বংশীয় রাজা চতুর্থ চার্লস পালাতে গিয়ে ফরাসি সেনার হাতে বন্দি হন।
স্পেনবাসীর দাবি :- রাজা চতুর্থ চার্লস বন্দি হলে তাঁর পুত্র ফার্দিনান্দের ওপর সিংহাসনের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। স্পেনবাসীও ফার্দিনান্দকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করে ফরাসি সেনাদের স্পেন ত্যাগের দাবি জানায়। কিন্তু নেপোলিয়ন স্পেনবাসীর দাবি অগ্রাহ্য করেন।
জোসেফের সিংহাসন লাভ :- নেপোলিয়ন চতুর্থ চার্লস ও ফার্দিনান্দকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজের ভাই জোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন (১৫ জুন, ১৮০৮ খ্রি.)।
উপসংহার :- নেপোলিয়নের উদারনৈতিক সংস্কারগুলি স্পেনে চালু করে জোসেফ সেখানকার জনগণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। তিনি স্পেন বাসীকে একটি উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তনেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
২৪। নেপোলিয়নের স্পেন দখলের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন দখল করে স্পেনের রাজা চতুর্থ চার্লস ও যুবরাজ ফার্দিনান্দকে নির্বাসনে পাঠান। এরপর তিনি নিজের ভাই জোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের সিংহাসনে বসালে স্পেনে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
বিদ্রোহ :- স্পেনের সর্বত্র নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ স্পেনবাসী তীব্র বিদ্রোহ শুরু করে। সর্বস্তরের সাধারণ স্পেনবাসীও মাতৃভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়নের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়।
প্রতিরোধ সমিতি :- স্পেনের বিভিন্ন স্থানে ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে অগণিত ‘জুন্টা’ বা বিদ্রোহী প্রতিরোধ সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতিগুলি স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে ফরাসি সেনাদলের বিরুদ্ধে আমরণ লড়াই শুরু করে। দেশের কেন্দ্রীয় জুন্টা প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যাডিজে নামক শহরে।
গেরিলা যুদ্ধ :- স্পেনের জাতীয়তাবাদীদের উদ্যোগে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধা বাহিনী গড়ে ওঠে। যোদ্ধাদের অগ্রগতিতে আতঙ্কিত হয়ে নেপোলিয়নের ভাই জোসেফ স্পেনের সিংহাসনে বসার মাত্র ১১ দিন পরই রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হন।
জাতীয় প্রতিরোধ :- স্পেনের বিভিন্ন ধারার বিদ্রোহী ও যোদ্ধাদের সমন্বয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শীঘ্রই জাতীয় বিদ্রোহ শুরু হয়। ডেভিড টমসনের মতে, “নেপোলিয়নের বাহিনী স্পেনে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।” বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ব্যাপকতায় নেপোলিয়নের বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে যায়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক জর্জ রুদে বলেছেন যে, “স্পেন অভিযান নেপোলিয়নের জীবনের একটি মারাত্মক ভুল ছিল।”
২৫। স্পেনের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের যুদ্ধের অগ্রগতির বিবরণ দাও। অথবা, স্পেনের বিরুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর যুদ্ধের গতিধারা উল্লেখ করো।
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন অভিযান করলে স্পেনবাসী ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। টানা ৭ বছর যুদ্ধ চলার পর ফরাসি বাহিনী ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে স্পেন ত্যাগে বাধ্য হয়।
দুঁপ-এর পরাজয় :- স্পেনের সর্বস্তরের মানুষ নেপোলিয়নের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে নামে। তারা চমকপ্রদভাবে বেলেনের যুদ্ধে (১৮০৮ খ্রি.) ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করলে ফরাসি সেনাপতি দুঁপ আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।
উপদ্বীপের যুদ্ধ :- স্পেনে নেপোলিয়নের বাহিনীর পরাজয়ের ঘটনা পোর্তুগালবাসীকে অনুপ্রাণিত করে। ফলে ফরাসি শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে স্পেন ও পোর্তুগালে একযোগে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে যা উপদ্বীপের যুদ্ধ (১৮০৮- ‘১৪ খ্রি.) নামে পরিচিত।
ইংল্যান্ডের ভূমিকা :- পোর্তুগাল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংল্যান্ডের সাহায্য চাইলে ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলি ১৩ হাজার সেনাসহ পোর্তুগালে হাজির হন এবং ভিমিয়েরো-র যুদ্ধে (১৮০৮ খ্রি.) ফরাসি সেনাপতি জুনো-কে পরাজিত করেন।
ট্যালাভেরার যুদ্ধ :- ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নেপোলিয়ন স্পেনে এসে নিজের ভাই জোসেফকে সেখানকার সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তবে তিনি শীঘ্রই ইউরোপের অন্যান্য সংকটে জড়িয়ে পড়লে আর্থার ওয়েলেসলি ট্যালাভেরার যুদ্ধে (১৮০৯ খ্রি.) ফরাসি সেনাপতি ভিক্টরকে পরাজিত করেন।
টোরেস ভেড্রাসের যুদ্ধ :- ফরাসি সেনাপতি ম্যাসেনা ১.৫ লক্ষ সৈন্য নিয়ে স্পেন অভিযান করে টোরেস ভেড্রাসের যুদ্ধে (১৮০৯ খ্রি.) পরাজিত হন।
উপসংহার :- নেপোলিয়ন রাশিয়া অভিযানের (১৮১২ খ্রি.) উদ্দেশ্যে স্পেন ও পোর্তুগাল থেকে বহু সৈন্য সরিয়ে নিলে ফরাসি বাহিনী স্যালামাঙ্কার যুদ্ধ (১৮১২ খ্রি.) ও ভিত্তোরিয়ার যুদ্ধে (১৮১৩ খ্রি.) পরাজিত হয়ে স্পেন ত্যাগে বাধ্য হয়।
২৬। স্পেনের যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের কারণ কী ছিল? অথবা, স্পেনের যুদ্ধে ফ্রান্সের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন দখল করার পর থেকে বারবার স্পেনের কাছে পরাজিত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত পরাজয়ের পর নেপোলিয়নের বাহিনী স্পেন ত্যাগে বাধ্য হয়। স্পেনের যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয় বা ফ্রান্সের ব্যর্থতার কারণ গুলি হল নিম্নরূপ। –
স্পেনের পরিবেশ :- পাহাড়-পর্বত ও জলাভূমিতে পূর্ণ স্পেনের ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হয়। দরিদ্র স্পেনে খাদ্যাভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ফরাসি সেনাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়।
বিভিন্ন সংকট :- নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন সংকটে ক্রমাগত যুক্ত হয়ে পড়ায় স্পেনের যুদ্ধে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের পর তিনি আর স্পেনে যেতে পারেন নি।
স্পেনবাসীর দেশপ্রেম :- ফরাসি আক্রমণের বিরুদ্ধে স্পেনবাসীর জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম ছিল অত্যন্ত গভীর ও আন্তরিক। স্পেনের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ে নামায় ফরাসি বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
গেরিলা যুদ্ধ :- স্পেনের গেরিলা যোদ্ধারা ফরাসি বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দিতে থাকে। গেরিলা যোদ্ধারা যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করে ফরাসি সেনাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়।
ইংল্যান্ডের সহায়তা :- ইংল্যান্ড অর্থ, অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে স্পেনকে সহায়তা করলে এবং ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলি স্পেনের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলে ফরাসি বাহিনীর সংকট তীব্র হয়ে ওঠে।
জোসেফের অযোগ্যতা :- নেপোলিয়ন তাঁর ভাই জোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসালেও স্পেনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো ক্ষমতা অযোগ্য ও অপদার্থ জোসেফের ছিল না।
উপসংহার :- স্পেনের যাজক ও পুরোহিতরা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলে আন্দোলন তীব্র হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসি বাহিনী ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।
২৭। উপদ্বীপের যুদ্ধের (১৮০৮-‘১৪ খ্রি.) তাৎপর্য বা ফলাফল কী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগাল ও ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন দখল করলে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে পোর্তুগাল ও স্পেন অসম যুদ্ধে শামিল হয়। এটি উপদ্বীপের যুদ্ধ (১৮০৮-১৪ খ্রি.) নামে পরিচিত। উপদ্বীপের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য ছিল। যেমন –
পতনের সূত্রপাত :- উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর চরম ব্যর্থতা নেপোলিয়নের পতনের পথ তৈরি করে দেয়। নেপোলিয়ন নিজেও স্বীকার করেছেন যে, “স্পেনীয় ক্ষতই আমাকে ধ্বংস করেছে।”
জাতীয়তাবাদের শক্তি :- স্পেনের মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ঐক্যবদ্ধ কোনো জাতির বিরুদ্ধে অভিযানের ফল কী হতে পারে তা স্পেনবাসী নেপোলিয়নকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ক্ষয়ক্ষতি :- উপদ্বীপের যুদ্ধের প্রথম তিন বছর শুধু স্পেনেই গড়ে ৩ লক্ষ ফরাসি সেনা মোতায়েন ছিল। এই বিশাল সেনাদলের জন্য প্রচুর অর্থব্যয় এবং যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি ফরাসি সেনার মৃত্যুর ফলে ফ্রান্স যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইউরোপে ব্যর্থতা :- স্পেন ও পোর্তুগালের যুদ্ধে নেপোলিয়নের সেনাদলের একটি বড়ো অংশ নিযুক্ত থাকায় ইউরোপের অন্যান্য যুদ্ধে তিনি ক্রমাগত সমস্যা ও ব্যর্থতার সম্মুখীন হন।
মর্যাদা হ্রাস :- এতদিন ইউরোপে নেপোলিয়নের যে অপরাজেয় ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল উপদ্বীপের যুদ্ধে তাঁর পরাজয়ের ফলে সেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। ফলে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জাগরণ ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন নেপোলিয়নের স্পেন অভিযানকে তাঁর ‘পতনের প্রথম ধাপ’ (‘First step towards ruin’) বলে অভিহিত করেছেন।
২৮। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার বিদ্রোহের পরিচয় দাও।
ভূমিকা :- টিলসিটের সন্ধির (১৮০৭ খ্রি.) পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল অস্ট্রিয়ার বিদ্রোহ।
বিদ্রোহের প্রস্তুতি :- নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক চার্লস এবং মন্ত্রী স্টাডিয়ন দেশের সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে অস্ট্রিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন।
ফ্রান্সের সংকট :- নেপোলিয়ন বেলেনের যুদ্ধে (১৮০৮ খ্রি.) স্পেনের কাছে পরাজিত হলে অস্ট্রিয়া যথেষ্ট উৎসাহিত হয়। এই সময় ফ্রান্সে অবস্থিত অস্ট্রীয় রাষ্ট্রদূত মেটারনিখ অস্ট্রীয় সরকারকে জানান যে, নেপোলিয়নের হাত থেকে অস্ট্রীয়ার হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের এটাই উপযুক্ত সময়।
ওয়াগ্রামের যুদ্ধ :- অস্ট্রিয়া ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে নেপোলিয়ন প্রবল বিক্রমে বিদ্রোহ দমনে নেমে পড়েন। ওয়াগ্রামের যুদ্ধে (১৮০৯ খ্রি.) অস্ট্রীয় বাহিনী ফ্রান্সের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে নেপোলিয়নের প্রতি আনুগত্য জানাতে বাধ্য হয়।
উপসংহার :- যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অস্ট্রিয়া ইলিরিয়া প্রদেশ ফ্রান্সকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার যুবরানি মেরি লুইসা-কে বিবাহ করে।
২৯। নেপোলিয়ন কেন রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন? অথবা, নেপোলিয়ন কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের কারণগুলি উল্লেখ করো।
ভূমিকা :- ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধির দ্বারা ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও এই সম্পর্ক শীঘ্রই ভেঙে যায়। এরপর ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন। নেপোলিয়ন কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের প্রধান কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ। –
টিলসিটের সন্ধির ত্রুটি :- টিলসিটের সন্ধিতে (১৮০৭ খ্রি.) নেপোলিয়ন তুরস্ক ও সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। ফলে রুশ জার ক্ষুব্ধ হন।
ওল্ডেনবার্গ দখল :- মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন রুশ জারের ভগ্নিপতি ওল্ডেনবার্গের ডিউকের রাজ্যটি দখল করে নেন। ফলে জার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন।
ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার ঘনিষ্ঠতা :- নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশীয় রাজকন্যা মেরি লুইসা-কে বিবাহ করলে রুশ জার আতঙ্কিত হন যে, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া মিলিত হয়ে রাশিয়ার ক্ষতি করবে।
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা :- রাশিয়া প্রথমে নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে এই ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করে। ফলে রাশিয়ার ওপর নেপোলিয়ন ক্ষুদ্ধ হন।
উপসংহার :- শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত তার বিখ্যাত ‘গ্রাঁদ আর্মি’ বা ‘মহান সেনাদল’ নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন।
৩০। নেপোলিয়ন কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের বিবরণ দাও।
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন তাঁর ‘মহান সেনাদলের’ ৬ লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন।
পোড়ামাটি নীতি :- রুশ বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে। তারা রাস্তাঘাট, সেতু ও জনপদ ধ্বংস করে, মাঠের ও গোলার ফসল আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেয়। এটি ‘পোড়মাটি নীতি’ নামে পরিচিত। এর ফলে ফরাসি বাহিনী রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে সংকটের সম্মুখীন হয়।
বোরোডিনোর যুদ্ধ :- সেনাপতি কুটুজভের নেতৃত্বে রুশ বাহিনী ফরাসি বাহিনীকে প্রতিরোধ করলে বোরোডিনোর যুদ্ধে (১৮১২ খ্রি.) নেপোলিয়ন তাদের পরাজিত করেন।
মস্কো অভিযান :- বোরোডিনোতে জয়লাভের পর ফরাসি বাহিনী ৭৫ মাইল দুর্গম পথ অতিক্রম করে মস্কোয় পৌঁছোয়। পথে খাদ্যাভাব, তীব্র শীত, বাসস্থানের অভাব ও মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে প্রচুর ফরাসি সৈন্যের মৃত্যু হয়।
রাশিয়া ত্যাগ :- এই সময় রাশিয়ায় তীব্র শীত, তুষারপাত, ঝড়, চরম খাদ্যাভাব ও ‘টাইফাস’ নামক জরের প্রকোপ শুরু হলে দিশেহারা নেপোলিয়ন তাঁর মহান সেনাদলের অবশিষ্ট সেনাদের দ্রুত স্বদেশে ফেরার নির্দেশ দেন।
উপসংহার :- স্বদেশে ফেরার পথেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্য জন্তুর আক্রমণ ও গেরিলা রুশ সেনাদের আক্রমণে প্রচুর ফরাসি সেনার মৃত্যু হয়। মাত্র ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার সেনা দেশে ফিরতে সক্ষম হয়।
৩১। রাশিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের কারণ কী ছিল? অথবা, রুশ অভিযানে ফ্রান্সের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
ভূমিকা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন রাশিয়া অভিযান শুরু করেন এবং তাঁর ‘মহান সেনাদল’ সেখানে বিপর্যস্ত হলে ১৯ অক্টোবর তিনি সেনাদলকে স্বদেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। রাশিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনীর পরাজয় ও ব্যর্থতার বিভিন্ন কারণ ছিল।
রাশিয়ার বিশালায়তন :- রাশিয়ার আয়তন বিশাল হওয়ায় রুশ বাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করে ক্রমাগত পিছু হটে এবং ফরাসি বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। ফরাসি বাহিনী শীঘ্রই সেখানে খাদ্যাভাব, পানীয় জলের অভাব, রুশ গেরিলা সেনাদের আক্রমণ প্রভৃতির ফলে বিপর্যস্ত হয়।
নেপোলিয়নের দম্ভ :- সীমাহীন দম্ভ নেপোলিয়নের বাস্তববোধ নষ্ট করে দেয়। ইংল্যান্ড ও উপদ্বীপের যুদ্ধ শেষ না করেই তিনি রাশিয়ার যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে এবং সংহতিবিহীন বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে ‘মহান সেনাদল’ গঠন করে মারাত্মক ভুল করেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ :- রাশিয়ার অভ্যন্তরে এবং স্বদেশে ফেরার পথে তীব্র শীত, তুষারপাত, ঝড়বৃষ্টি প্রভৃতির ফলে প্রচুর ফরাসি সেনার মৃত্যু হয়।
মহামারির প্রাদুর্ভাব :- রাশিয়ায় ফরাসি বাহিনীর মধ্যে ‘টাইফাস’ নামক ভয়ানক জ্বর ও অন্যান্য মহামারি ছড়িয়ে পড়লে প্রচুর ফরাসি সেনার মৃত্যু হয়।
রুশবাসীর উদ্যোগ :- রুশ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় রাশিয়ায় ফরাসিদের পরাজয়ের যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন রাশিয়ার সাধারণ মানুষের সংগ্রামী মানসিকতাকে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয়তা নেপোলিয়নের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “রাশিয়ার যুদ্ধ ছিল নেপোলিয়নের সবচেয়ে নাটকীয় ও ক্ষতিকারক পরাজয়।”
৩২। নেপোলিয়ন কীভাবে জার্মানিতে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন? নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিবরণ দাও। [২+২]
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন জার্মানিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও জার্মান রাজ্য প্রাশিয়ার নেতৃত্বে শীঘ্রই নেপোলিয়ন বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।
জার্মানিতে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য ধ্বংস করে ছোটো ছোটো প্রায় ৩০০টি জার্মান রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনটি রাষ্ট্র-সমবায় গড়ে তোলেন। এগুলি হল –
(ক) কনফেডারেশন অব দ্য রাইন :- এই সমবায়ের ‘প্রোটেক্টর’ হিসেবে নেপোলিয়ন নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
(খ) কিংডম অব ওয়েস্টফ্যালিয়া :- এই সমবায়ের সিংহাসনে নেপোলিয়ন নিজের ভাই জেরোম-কে বসান।
(গ) গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়ারশ :- স্যাক্সনিকে এই সমবায় পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে নেপোলিয়ন এখানে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন :- রাশিয়ায় নেপোলিয়নের চরম ব্যর্থতার পর তাঁর বিরুদ্ধে জার্মানিতে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। যেমন –
(ক) জাগরণ :- রাশিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়নের শোচনীয় পরাজয় ঘটলে জার্মান রাজ্যগুলিতে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র জাতীয়তাবাদী জাগরণ দেখা দেয়। এই জাগরণে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে জার্মান রাজ্য প্রাশিয়া।
(খ) চতুর্থ শক্তিজোটের আক্রমণ :- ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা চতুর্থ শক্তিজোটের সদস্য প্রাশিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ফ্রান্সে চতুর্দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়।
উপসংহার :- ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির লাইপজিগের যুদ্ধে (বা জাতিসমূহের যুদ্ধে) নেপোলিয়নের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং জার্মানি নেপোলিয়নের শাসনমুক্ত হয়।
৩৩। লাইপজিগের যুদ্ধ (১৮১৩ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
ভূমিকা :- রাশিয়া অভিযানে (১৮১২ খ্রি.) ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের চরম ব্যর্থতার পর রাশিয়া, প্রাশিয়া, ইংল্যান্ড, তুরস্ক, সুইডেন, প্রাশিয়া প্রভৃতি দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ শক্তিজোট গড়ে তোলে। এই জোটের সাথে নেপোলিয়নের লাইপজিগের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
জার্মানির মুক্তি আন্দোলন :- ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেয় জার্মান রাজ্য প্রাশিয়ার জনগণ। প্রাশিয়ার এই ফ্রান্স-বিরোধী জাগরণ সমগ্র জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে।
শক্তিজোটের আক্রমণ :- এই অবস্থায় চতুর্থ শক্তিজোটের সদস্য প্রাশিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশগুলি ফ্রান্সকে চুতর্দিক থেকে আক্রমণ করে। নেপোলিয়ন ড্রেসডেনের যুদ্ধে (১৮১৩ খ্রি.) অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে।
লাইপজিগে বিপর্যয় :- মিত্রশক্তি শীঘ্রই ফ্রান্সকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। জার্মানির লাইপজিগে টানা তিন দিনের যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে জার্মানি নেপোলিয়নের শাসনমুক্ত হয়।
ফরাসি সাম্রাজ্যে ভাঙন :- লাইপজিগের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে নেপোলিয়নের সুবিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। ফরাসি সাম্রাজ্য থেকে ওয়েস্টফ্যালিয়া, মেক্লেনবার্গ, কনফেডারেশন অব দ্য রাইন প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে এবং অস্ট্রিয়া তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পায়।
উপসংহার :- লাইপজিগের যুদ্ধে ইউরোপের ১৩টি জাতি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বলে এটি ‘জাতিসমূহের যুদ্ধ’ (১৮১৩ খ্রি.) নামে পরিচিত।
৩৪। লাইপজিগের যুদ্ধের (১৮১৩ খ্রি:) পর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে চতুর্থ শক্তিজোটের লড়াইয়ের বিবরণ দাও। অথবা, লাইপজিগের যুদ্ধের (১৮১৩ খ্রি.) পর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতির মুক্তিযুদ্ধের পরিচয় দাও।
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন চতুর্থ শক্তিজোটের কাছে লাইপজিগের যুদ্ধে (১৮১৩ খ্রি.) শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পরও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপে মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত থাকে।
ফ্রাঙ্কফার্ট প্রস্তাব :- নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লাইপজিগের যুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তি ফ্রাঙ্কফার্টের প্রস্তাব (নভেম্বর, ১৮১৩ খ্রি.) দ্বারা নেপোলিয়নকে ফ্রান্সের রাজা বলে স্বীকার করে নেয় এবং ফ্রান্সকে তার প্রাকৃতিক রাজ্যসীমা বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু নেপোলিয়ন এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন।
ফ্রান্স আক্রমণ :- নেপোলিয়ন ফ্রাঙ্কফার্ট প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে বিজয়ী মিত্রশক্তি ফ্রান্সকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে এবং প্যারিস দখল করে (মার্চ, ১৮১৪ খ্রি.) নেয়।
ফঁতেনব্লু -এর সন্ধি :- পরাজিত সম্রাট নেপোলিয়ন বিজয়ী মিত্রশক্তির সঙ্গে ফঁতেনব্লু-এর সন্ধির (৬ এপ্রিল, ১৮১৪ খ্রি.) দ্বারা ফরাসি সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁকে ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
প্যারিসের সন্ধি :- বিজয়ী মিত্রশক্তি প্যারিসের প্রথম সন্ধির (মে, ১৮১৪ খ্রি.) দ্বারা বুরবোঁ বংশীয় অষ্টাদশ লুইকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসায় ও ফ্রান্সকে বিপ্লব-পূর্ববর্তী সীমানা ফিরিয়ে দেয়।
উপসংহার :- নির্বাসন জীবন ত্যাগ করে প্যারিসে যাত্রাকালে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ নেপোলিয়নকে বিপুল অভ্যর্থনা জানায় এবং বহু সেনা তাঁর পক্ষে যোগ দেয়। এই সময় তিনি একশো দিন রাজত্ব করেন।
৩৫। শতদিবসের রাজত্ব’ বলতে কী বোঝ? অথবা, নেপোলিয়ন কীভাবে শতদিবস রাজত্ব করেন?
ভূমিকা :- চতুর্থ শক্তিজোটের কাছে পরাজিত হয়ে নেপোলিয়ন সিংহাসন ত্যাগ করে এলবা দ্বীপে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। নেপোলিয়ন নির্বাসনে থেকেও মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
ইউরোপের পরিস্থিতি :- নেপোলিয়ন নির্বাসনকালে ইউরোপের ঘটনাবলির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। এই সময় ফরাসি রাজা অষ্টাদশ লুই জনগণের কাছে শীঘ্রই অপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ভিয়েনা সম্মেলনে বিজয়ী শক্তিবর্গের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন :- ফ্রান্স ও ফ্রান্সের বাইরে জটিলতার পরিস্থিতিতে নেপোলিয়ন এলবা দ্বীপের নির্বাসন ত্যাগ করে গোপনে ফ্রান্সে ফিরে আসেন। তিনি ১০৫০ জন সৈন্য নিয়ে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ ফ্রান্সের কান শহরে হাজির হয়ে রাজধানী প্যারিসের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
জনতার অভ্যর্থনা :- প্যারিসে যাত্রাকালে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ নেপোলিয়নকে বিপুল অভ্যর্থনা জানায় এবং বহু সেনা তাঁর পক্ষে যোগ দেয়। তিনি গ্রেনক্স নগরে পৌঁছে জানান যে, কৃষকদের স্বার্থরক্ষা, দেশে শান্তিপ্রতিষ্ঠা এবং বিদেশিদের হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করাই তাঁর ফ্রান্সে ফিরে আসার প্রধান কারণ।
‘সম্রাট’ হিসেবে ঘোষণা :- নেপোলিয়ন লিয়ঁ নগরীতে পৌঁছে নিজেকে ‘সম্রাট’ হিসেবে ঘোষণা করলে অষ্টাদশ লুই সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যান।
উপসংহার :- এই সময় নেপোলিয়ন প্যারিসে এসে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত মোট ১০০ দিন রাজত্ব করেন। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘শতদিবসের রাজত্ব’ নামে পরিচিত।
৩৬। ওয়াটারলু-এর যুদ্ধ সম্পর্কে কী জান?
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন এলবা দ্বীপের নির্বাসন থেকে গোপনে ফ্রান্সে ফিরে এসে শাসনক্ষমতা দখল (১৮১৫ খ্রি.) করলে ফ্রান্স- বিরোধী বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গ তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আক্রমণের উদ্যোগ :- নেপোলিয়ন-বিরোধী মিত্রশক্তি নেপোলিয়নকে ‘আইন-বহির্ভূত ব্যক্তি’ আখ্যা দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্রান্স আক্রমণের উদ্যোগ নেয়।
আক্রমণ :- ইংল্যান্ড, প্রাশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সেনাদল বিভিন্ন দিক থেকে ফ্রান্স আক্রমণ করে। তীব্র আক্রমণ সত্ত্বেও নেপোলিয়নের বাহিনী প্রথম পর্যায়ে লিঞ্জি ও কোয়াটার ব্রাস-এর যুদ্ধে (১৮১৫ খ্রি.) জয় লাভ করে।
ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজয় :- প্রাথমিক সাফল্যের পর ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলি বা ডিউক অব ওয়েলিংটনের কাছে ওয়াটারলুর যুদ্ধে (১৮ জুন, ১৮১৫ খ্রি.) নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ১৫ জুলাই তিনি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
নির্বাসন :- ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হলে বিজয়ী শক্তিবর্গ তাঁকে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়। সেখানে অত্যন্ত অনাদরে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ৫ মে এই বীর যোদ্ধার মৃত্যু হয়।
উপসংহার :- ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের প্রায় ৩৭ হাজার এবং ইংল্যান্ডের প্রায় ১৩ হাজার সেনার মৃত্যু হয়।