উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: সাম্রাজ্য: সংজ্ঞা, রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে পার্থক্য হতে সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা দাও? মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলোচনা কর।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলোচনা
প্রশ্ন:- সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা দাও? মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলোচনা কর।
সাম্রাজ্য শব্দের অর্থ
ইংরেজি Empire শব্দটি লাতিন শব্দ ইমপিরিয়াম থেকে এসেছে, যার অর্থ হল শক্তি।
সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা
সাধারণভাবে সাম্রাজ্য বলতে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের অন্তর্গত একজন সম্রাট সম্রাজ্ঞীর অধীনে থাকা এমন এক বিস্তৃত ভূখণ্ড বা বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রকে বোঝায় যা রাজ্যের চেয়ে সুবিস্তৃত হবে, যেখানে সর্বদা বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস থাকবে এবং সেইসব জাতি বা সম্প্রদায়কে শাসন করার উদ্দেশ্যে সম্রাটের একটি সুনির্দিষ্ট শাসন কাঠামো থাকবে।
অন্যভাবে বলা যায়, সাম্রাজ্য হল কোনো শাসকের নেতৃত্বাধীন সেই ভৌগোলিক অঞ্চল যে অঞ্চল সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সীমানার প্রসার ঘটায়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, যখন কোনো ভূখণ্ডের শাসক সম্রাট উপাধি ধারণ করেন তখন তার অধীন রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্য বলা যেতে পারে।
রাজনৈতিক ধারণা অনুসারে, সাম্রাজ্য বলতে ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত বিভিন্ন রাজ্য ও জাতির ঐক্যবদ্ধ একক বোঝায় যেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করে কোনো রাজতন্ত্র অথবা কয়েকজনের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, সাম্রাজ্য হল রাজনৈতিক ও সামরিক ভিত্তিতে গঠিত ভূখণ্ডে সেই জনসমষ্টি, যারা সংস্কৃতিগতভাবে এবং জাতিগতভাবে শাসকগোষ্ঠীর থেকে পৃথক।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনা
প্রাচীনকালে ভারতে মৌর্য এবং ইউরোপে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্বে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটলেও উভয় সাম্রাজ্য অন্ততঃ কিছুকাল সমসাময়িক ছিল। এই দুই সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের আলোচনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সাদৃশ্য
প্রথমেই মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সাদৃশ্য গুলি আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন –
(১) সুবিশাল সাম্রাজ্য
প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে একের পর এক দখল করে মৌর্য সাম্রাজ্য বিশাল আকার ধারণ করেছিল। অন্যদিকে ম্যাসিডনীয় সম্রাটরাও প্রতিবেশী ক্ষুদ্র গ্রিক পলিসগুলি ও অন্যান্য অঞ্চল একে একে দখল করে নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে উভয় সাম্রাজ্যেরই প্রধান ভরসা ছিল সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনী।
(২) বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র
মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পরবর্তীকালে বিন্দুসার, সম্রাট অশোক প্রমুখ মৌর্য শাসকরা বংশানুক্রমিক অধিকারের ভিত্তিতেই সিংহাসন লাভ করেন। একইভাবে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ছিল বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
(৩) শাসন কাঠামো
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতে এক বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি সামরিক, বিচার, রাজস্ব প্রভৃতি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। একইভাবে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যে সুশাসনের উদ্দেশ্যে সম্রাটরা বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন।
(৪) স্থাপত্য ও শিল্পকলা
মৌর্য সম্রাটদের আমলে বিভিন্ন প্রাসাদ, স্তূপ, গুহা ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। ম্যাসিডনীয় সম্রাটরাও বেশ কিছু নির্মাণকার্য করেন। আলেকজান্ডার ৭০ টি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন।
(৫) অর্থনৈতিক অগ্রগতি
মৌর্য রাজাদের শাসনকালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। মৌর্য শাসনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃষিকাজে উৎসাহ দেওয়া হয়। একইভাবে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যেও যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বৈসাদৃশ্য
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সাদৃশ্য যেমন আছে তেমনি বৈসাদৃশ্যও আছে। যেমন –
(১) স্থায়ীত্বগত পার্থক্য
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সম্রাট অশোক -এর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকাল মৌর্য সম্রাজ্যের চূড়ান্ত আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু সেই হিসাবে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল ছিল অনেক কম।
(২) সভ্যতার প্রসারে পার্থক্য
ভারতের প্রাচীন মৌর্য সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানার ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সম্রাট অশোকের উদ্যোগে বৌদ্ধ ধর্মের যতটা প্রসার ঘটেছিল অন্যান্য ক্ষেত্রে ততটা প্রসার লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, আলেকজাণ্ডারের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী না হলেও তার দিগ্বিজয়ের ফলে গ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি নিজস্ব ক্ষুদ্র অঞ্চলের গণ্ডি অতিক্রম করে বিস্তৃত এক অঞ্চলে প্রসার লাভ করেছিল।
(৩) সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণগত পার্থক্য
মৌর্য শাসনকালে ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত ছিল। শিল্পকলার ক্ষেত্রে অতি সামান্য বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও মৌর্য সংস্কৃতি মূলত ভারতীয় সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিলল। কিন্তু ম্যাসিডনীয় সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের ফলে গ্রিসের সঙ্গে প্রাচ্যের যে যোগসূত্র রচিত হয়েছিল তার ফলে প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটেছিল।
(৪) ধর্মের প্রসারে পার্থক্য
মৌর্য যুগে বিশেষ করে, মৌধ সম্রাট অশোকের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে দূর দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ম্যাসিডনীয় সম্রাটরা নিজেদের ধর্মের প্রসারে এরূপ কোনো ব্যাপক উদ্দোগ গ্ৰহণ করেননি।
উপসংহার
আলেকজান্ডার কর্তৃক স্থাপিত ব্যাকট্রিয়ার গ্রিক উপনিবেশে শিল্প, মুদ্রা, শাসনব্যবস্থা প্রভৃতিতে গ্রিক প্রভাব সুস্পষ্পট; এই অঞ্চলে শেষপর্যন্ত গ্রিকরা ভারতীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।