উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায় – ঔপনিবেশিক ভারতের শাসন হতে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হল।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট আলোচনা
প্রশ্ন:- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
উত্তর:- ভূমিকা :- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিশেষ ধারা হল কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির অবদানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
প্রেক্ষাপট
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট ছিল –
(ক) শ্রমিক অসন্তোষ
ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপুরণে জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা প্রভৃতির দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রসার সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়।
(খ) হুইটলি কমিশন
শ্রমিকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি ও আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের ক্ষোভ ও আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন’ গঠন করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে।
(গ) শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী আইন
বড়োলাট লর্ড আরউইন শিল্পবিরোধ বিল’ ও ‘জননিরাপত্তা বিল’ নামে শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী দুটি আইন পাসের উদ্যোগ নেন। শিল্পবিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক বিরোধের মীমাংসার কথা বলা হয়। জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ।
মামলা
কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ ও শ্রমিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ডাঙ্গে-সহ ৩২ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এটি ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।
মামলায় অভিযুক্ত নেতা
৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। এঁরা হলেন ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি এবং লেস্টার হাচিনসন।
মামলার রায়
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড প্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, কে. এন. জোগেলকর, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ।
গান্ধিজির ভূমিকা
কংগ্রেস নেতা গান্ধিজি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষ সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।
পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা
বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাদের কারাদণ্ড সত্ত্বেও ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কমিউনিস্ট দলের প্রভাবে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।
বামপন্থী আদর্শের প্রসারে পরোক্ষ সহায়তা
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে বামপন্থার প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছোলে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।
উপসংহার :- শুধু ভারতে নয় ভারতের বাইরেও বহু জ্ঞানীগুণি মানুষ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাস্কি, দার্শনিক রোলাঁ প্রমুখ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।