পঞ্চম অধ্যায়: জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা কর। (২০১৬)
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব
ভূমিকা :- ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন পাস হলে সারা দেশে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর মধ্যে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আর এর চূড়ান্ত ও সবচেয়ে করুন পরিণতি ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
রাওলাট আইন -এর প্রতিবাদে গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশ জুড়ে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৩ ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে জেনারেল ও’ ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে সরকারি মতে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয়। যদিও বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। বর্বর ব্রিটিশ পুলিশের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
প্রেক্ষাপট
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ কাজ করেছিল। যেমন –
ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অত্যাচার
অত্যাচারী বৃটিশ সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল এর অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে। জুলুম করে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ এবং বিদ্রোহ প্রতিরোধ করতে পাঞ্জাবীদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো, বঞ্চনার প্রতিবাদ বেকার শিখ সৈন্যদের সমাবেশ প্রভৃতি ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে।
কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রণয়ন
সরকার ভারতীয়দের যাবতীয় স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নিষ্ঠুর দমনমূলক রাওলাট আইন (১৯১৯) প্রবর্তন করলে দেশবাসী ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে। এবং এই বিক্ষোভের আঁচ পাঞ্জাবে সবথেকে গভীর ও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১০ এপ্রিল সরকার অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপাল -কে হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। মারমুখী জনতা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, টেলিগ্রাফ লাইন ও ইউরোপীয় নারী-পুরুষের ওপর আক্রমণ চালায়।
সামরিক শাসন জারি
অমৃতসরে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে জেনারেল মাইকেল ও’ ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। সামরিক আইন জারি করে ১১ ই এপ্রিল শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশ
এই অবস্থায়১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে প্রায় দশ হাজার জনতা সমবেত হয়েছিল দুই জনপ্রিয় নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও ডক্টর সত্যপালের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। সভাস্থলটি চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। সভাস্থলে প্রবেশের জন্য ছিল একটি পথ এবং প্রস্থানের জন্য ছিল চারটি সংকীর্ণ গলিপথ। এই নির্দিষ্ট স্থানে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে উপস্থিত হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা ১১ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি এবং জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধের কথা জানত না।
হত্যাকান্ডের বিবরণ
পাঞ্জাবের সামরিক শাসন কর্তা মাইকেল ও’ ডায়ার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং মাঠের প্রবেশ পথ আটকে ৫০ টি রাইফেল থেকে জনগণকে কোন প্রকার সতর্কবার্তা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ দেন। সেনাবাহিনী ১০ মিনিট ধরে প্রায় ষোলশ রাউন্ড গুলি চালায়। প্রচুর মানুষ হতাহত হয়। সরকারি হিসাব অনুসারে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল ১২০০ জন। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্ষমা স্বীকার করা হয়নি। শুধু তাই নয় ওই দিন অমৃতসরে সান্ধ্য আইন জারি করে মৃতদেহগুলোকে তাদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া কিংবা আহতদের সেবা শুশ্রূষা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
গুরুত্ব/প্রতিক্রিয়া
এই ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সারা দেশে বিদেশে সর্বত্রই এই নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যেমন –
ক্ষোভ প্রকাশ
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেছেন যে, “এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।”
উপাধি ত্যাগ
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘৃণ্য ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন।
জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ
জাতীয় কংগ্রেসও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে। কংগ্রেস নেতা সি. এফ. এন্ড্রুজ এই ঘটনাকে ‘কসাইখানার গণহত্যা’ -র সমতুল্য বলে নিন্দা করেন। গান্ধিজি তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব। একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।”
ইংরেজদের প্রতিবাদ
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বহু ইংরেজ এই ঘটনাকে মর্মান্তিক ও নজিরবিহীন বলে নিন্দা করেছেন। ভাবি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন – “এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, পাশবিক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।”
মূল্যায়ন :- পরিশেষে বলা যায় ব্রিটিশ সরকার কর্ণপাত না করলেও শেষ পর্যন্ত উধম সিং নামে এক ভারতীয় 1941 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ও’ ডায়ারকে হত্যা করে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।