উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়: সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করা হল।
সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
প্রশ্ন:- সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা কর।
ভূমিকা :- উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তৎকালীন বাংলার জরাগ্রস্ত ও স্থবির সমাজ ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করতে তিনি আমরণ লড়াই করেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর নারী মুক্তি আন্দোলন প্রণিধানযোগ্য। নারী মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন ভারত -এর অন্যতম পথিকৃৎ।
সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বিদ্যাসাগর তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অবদান রেখেছেন। যেমন –
(ক) বিধবা বিবাহ
সে যুগে বাংলার ঘরে ঘরে যে অগণিত অকাল বিধবার জন্ম দিয়েছিল তার প্রতিকারে নেমেছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি বিধবাবিবাহ প্রথা আইন করে বলবৎ করার জন্য লড়াই করেন এবং সাফল্যও পান। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার ১৫ নং আইন দ্বারা বিধবা-বিবাহ আইন সিদ্ধ করে। তিনি নিজের পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামক এক অষ্টাদশী বিধবার প্রথম বিবাহ দেন ৷ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি এরূপ ৬০টি বিবাহ দেন।
(খ) বাল্যবিবাহ
বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেন । তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে একটি আইন পাস করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর ধার্য করে।
(গ) বহুবিবাহ
সেই যুগে হিন্দুসমাজে পুরুষের বহুবিবাহ করার অধিকার ছিল। সমাজে এই প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। এই প্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেন। যদিও এবিষয়ে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি।
(ঘ) অন্যান্য প্রথা
এ ছাড়া বিদ্যাসাগর সেযুগের কৌলিন্যপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা ও কুষ্ঠরোগীকে হত্যা করার প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর উদ্যোগেই খ্যাতনামা চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার ‘বৈদ্যনাথ রাজকুমারী’ নামে কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করেন।
শিক্ষা সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
গভীর মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ বিদ্যাসাগর প্রথম থেকেই শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন। শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলি তিনি নিয়েছিলেন সেগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) বিদ্যালয় স্থাপন
বিদ্যাসাগর শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে সবার আগে জোর দিয়েছিলেন বিদ্যালয় স্থাপনের ওপর। তিনি নিজে বিভিন্ন জেলায় ২০ টি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার বেশিরভাগই তার নিজের খরচে চলত। এছাড়া ১৮৭২ খ্রিঃ তিনি নিজে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।
(খ) নারী শিক্ষায় প্রসার
বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন সমাজে নারীদের শিক্ষিত করা না গেলে তাদের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। সেইকারণে নারী শিক্ষা প্রসারে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি হিন্দু ফিমেল স্কুল (১৮৪৯ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। প্রায় এক হাজার তিনশো ছাত্রী এই বিদ্যালয়গুলিতে পড়াশুনা করত।
(গ) মাতৃভাষায় শিক্ষাদান
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপর বিদ্যাসাগর প্রথম থেকেই জোর দিয়েছিলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। পাশাপাশি তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
(ঘ) পাঠ্যপুস্তক রচনা
শুধুমাত্র বিদ্যালয় স্থাপন নয়, পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্বও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বর্ণপরিচয়, শিশুশিক্ষা, কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলি সহ সংস্কৃত শিক্ষার সুবিধার জন্য সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী প্রভৃতি রচনা করেন। এছাড়াও আখ্যান মঞ্জরি, শব্দ মঞ্জরি, শ্লোক মঞ্জরি, ব্রজবিলাস, রত্নপরীক্ষা প্রভৃতি বই রচনা করেন যা বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও সীতার বনবাসের মতো গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা গদ্য লেখার নতুন পথ রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি ছিলেন ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী।‘
(ঙ) নিয়মকানুন তৈরি
শিক্ষার কাজে তিনি বেশকিছু নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানরা সংস্কৃত পড়তে পারবে এই নীতি তুলে দিয়ে সকল বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত পড়ার দ্বার খুলে দেন তিনি। এছাড়াও শিক্ষকদের ইচ্ছামতো যাতায়াত বন্ধ করে নতুন নিয়ম কানুন বলবৎ করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি শুভদিন অনুসারে ছুটির দিন তুলে দিয়ে রবিবার ছুটির নিয়ম চালু করেন।
মূল্যায়ন :- সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ আছেন, বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।’ এই নির্ভীক সমাজসংস্কারক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন এই ভীরুর দেশে তিনিই একমাত্র পুরুষ সিংহ। কবি মধুসূদন দত্ত তার নিঃস্বার্থ ব্রত ও হৃদয়বত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
I am a student of the best of luck
Thank you so much