২০২৫ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাসের সাজেশন্ ভিত্তিক পিডিএফ নোটস্ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করুণ👇

👉Chat on WhatsApp

ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়: উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সিলেবাস (চতুর্থ অধ্যায়) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ আলোচনা করা হল।

ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ

৩. ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ দাও।

আদিবাসী সম্প্রদায়

সূচনা :- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারত -এর সর্বাধিক শােষিত ও নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়। সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, ওরাঁও, হাে, ভূমিজ, খন্দ, গােণ্ড, ভারলি, নাগারা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায় প্রকৃতির কোলে বসবাস করত এবং প্রকৃতির সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শােষণের শিকার হয়ে তারা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।

কর আরােপ

ব্রিটিশ সরকার উনিশ শতকে আদিবাসী সম্প্রদায়কে আইন, শাসন ও বিচার-ব্যবস্থার আওতায় আনে। ভূমি বন্দোবস্ত করে সরকার আদিবাসীদের জমির ওপর কর আরােপ করে ও আদিবাসী কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ে তীব্র নির্যাতন চালায়।

‘দিকু’দের ভূমিকা

বহিরাগত জমিদার জোতদার, বণিক, মহাজন, ঠিকাদার, দালাল প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভােগী বহিরাগতদের আদিবাসীরা ‘দিকু’ বলত। ‘দিকু’-রা আদিবাসীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা ও শােষণ চালায়।

অরণ্যের অধিকার ব্যাহত

আদিবাসীরা পাহাড় ও মালভূমির অরণ্যাঞলে ঝুম চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করত এবং অরণ্য থেকে বিভিন্ন সম্পদ আহরণ করত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত অরণ্যাঞ্চলে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ করে এবং অরণ্য-সম্পদের ওপর সরকার একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

 সামাজিক আগ্রাসন

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন সামাজিক আগ্রাসনের শিকার হয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি তাদের খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। নতুন পাশ্চাত্য খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রভাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়।

শােষণ ও বঞ্চনা

সারা দেশে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হলে প্রচুর আদিবাসী শ্রমিককে এই কাজে নিয়ােগ করা হয়। কয়লা উৎপাদনের কাজেও প্রচুর সংখ্যক আদিবাসী শ্রমিক নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে দিনের পর দিন নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়।

মুক্তির উদ্যোগ

ব্রিটিশ সরকার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য শােষকদের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে আদিবাসী সম্প্রদায় প্রয়াস চালায়। তারা নিজেদের সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে। শােষণ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা ছােটোনাগপুর অঞ্চলের কোল উপজাতি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং বিহারের সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহের নেপথ্যেও একই ধরনের পটভূমি কাজ করেছিল।

উপসংহার :- ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী সম্প্রদায় সর্বাধিক সামাজিক অসাম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশবিরােধী মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) বা জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে ভারতের শােষিত ও নিপীড়িত আদিবাসী সম্প্রদায়ই প্রথম ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের ভিত তৈরি করে। তাদের বিদ্রোহ ব্রিটিশবিরােধী কৃষক বিদ্রোহগুলিকেও শক্তি সরবরাহ করে।

দলিত সম্প্রদায়

সূচনা:- খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে বৈদিক সভ্যতার যুগ থেকেই ভারতে জাতিরবৈষম্যের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে আরও বহু অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য জাতির উদ্ভব ঘটে। এই অনগ্রসর, শােষিত ও নির্যাতিত সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনকালে দলিত নামে পরিচিত হয়। এই সময় তারা উচ্চবর্ণের নানা শােষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই দলিতদের কাছে ইংরেজ বিরােধিতার চেয়ে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অবহেলার শিকার

শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা গ্রামগঞ্জের দলিত শ্রেণির মানুষ সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষা জানত না বলে তারা নিজেদের কথ্যভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করত। উচ্চবর্ণের মানুষ দলিতদের এই কথ্যভাষাকে খুবই অবজ্ঞা করত। ব্রাক্ষ্মণরা দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষাকে যথেষ্ট ঘৃণার চোখে দেখত।

কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি

জাতীয় কংগ্রেসে উচ্চবর্ণের নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তারা অনেকেই জাতিভেদপ্রথার সমর্থক ছিল। কংগ্রেস নেতাদের এরূপ মনােভাবের ফলে দলিতদের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তারা ক্রমে কংগ্রেসের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি চেষ্টার সক্রিয় চেষ্টা চালায়। অবশ্য মহাত্মা গান্ধি হরিজন আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেসের প্রতি দলিতদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গান্ধিজির সাবধানী উদ্যোগ দলিতদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

বাংলায় দলিতদের সক্রিয়তা

উনবিংশ শতকে বাংলার দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ব্রায়ণ্য আধিপত্য ও শােষণের বিরুদ্ধে সরব হয়। প্রথমদিকে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রমুখ দলিত নেতা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শােষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচদের তপশিলি জাতিভুক্ত করলে এর বিরুদ্ধে তারা সামাজিক আন্দোলন শুরু করে।

দলিত সংগঠন

দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অব্রাহ্মণদের মধ্যে যােগাযােগ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জাস্টিস পার্টি (১৯১৭ খ্রি.) নামে দলিতদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে অনুষ্ঠিত দলিত নেতাদের সম্মেলনে দলিত আন্দোলনের গতি আসে। এখানে সর্বভারতীয় নিপীড়িত সমিতি গঠিত হয়। এস. সি. রাজা এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ড. আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দাবি করেন।

আম্বেদকরের ভূমিকা

গান্ধিজি-সহ অন্যান্য কিছু নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অস্পৃশ্যতা-বিরােধী দলিত নেতা আম্বেদকরের কাছে বিশেষ মূল্যবান ছিল না। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ বা উচ্চবর্ণের সঙ্গে মেলামেশার অধিকারের চেয়ে তিনি দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটানাের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন এবং প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি গ্রন্থটি পুড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরােধিতা করেন। তিনি দলিতদের শিক্ষা, সংগঠন ও বিক্ষোভ আন্দোলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।

পুনা চুক্তি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড তাঁর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ (১৯৩২ খ্রি.) নীতির মাধ্যমে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিলে গান্ধিজি এর তীব্র প্রতিবাদ করে অনশন শুরু করেন। (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২খ্রি.)। শেষপর্যন্ত পুনা চুক্তির (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রি.) মাধ্যমে আম্বেদকর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেন এবং গান্ধিজিও দলিতদের আরও বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষণের দাবি মেনে নেন।

উপসংহার :- আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় তপশিলি জাতি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে দলিত আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেসও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্-মুহূর্তে দলিত নেতা আম্বেদকরকে সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। একজন দলিত নেতার নেতৃত্বাধীন কমিটি স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার অধিকার পায়। তাঁর নেতৃত্বে রচিত নতুন সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘােষণা করা হয়।

Leave a Comment