উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় “ধর্ম” হতে ক্রুসেডের কারণগুলি আলোচনা করা হল।
ক্রুসেডের কারণগুলি আলোচনা
প্রশ্ন:- ক্রুসেডের কারণগুলি আলোচনা কর।
উত্তর:- ভূমিকা:- খ্রিস্টধর্মের পবিত্র প্রতীক ক্রুস থেকেই ক্রুসেড নামের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাচ্যের মুসলিমধর্মাবলম্বী তুর্কি ও পশ্চিম ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রায় দুশো বছর ধরে যে যুদ্ধ হয় তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। ক্রুসেডের পশ্চাতে নানান কারণ ছিল। যেমন –
(ক) ধর্মীয় কারণ
ক্রুসেডের ধর্মীয় কারণ ছিল নিম্নরূপ –
(১) রোমান চার্চের হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা
১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক (বা পূর্ব ইউরোপীয়) চার্চের সঙ্গে রোমান চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পোপ দ্বিতীয় আরবান রোমান চার্চের হৃত গৌরব ও ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড আন্দোলনে জয়ী হলে খ্রিস্টানদের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ হবে।
(২) জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় খ্রিস্টানদের প্রচেষ্টা
জিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র তীর্থস্থান। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেমের দখল নেয়। খ্রিস্টান যাজক, অভিজাত এবং রাজারা সংঘবদ্ধ হয় ও সেলজুক তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেন।
(৩) জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় মুসলিমদের প্রচেষ্টা
আবার মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম ছিল হজরত মহম্মদ, হজরত মুসা ও হজরত দাউদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রভূমি। তাই মুসলিমরাও জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় উদ্যত হলে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
(খ) রাজনৈতিক কারণ
ক্রুসেডের রাজনৈতিক কারণ ছিল নিম্নরূপ –
(১) ইসলামের অগ্রগতি রোধ
হজরত ওমরের আমল থেকে, রাজ্যবিজয় ও ধর্মপ্রচারের মধ্যে দিয়ে ইসলামের সম্প্রসারণ শুরু হয়। রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মিশর, সিরিয়া, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইটালি, সিসিলি-সহ সমগ্র পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। খ্রিস্টানরা ইসলামের এই অগ্রগতি রোধে সচেষ্ট হয়।
(২) দক্ষতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা
অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ফ্রাঙ্করাজ চার্লস মার্টেল আরবদের আক্রমণ রোধের লক্ষ্যে এক সুনিপুণ যোদ্ধাবাহিনী গড়ে তোলেন। খ্রিস্টধর্মের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য তারা ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করে।
(গ) অর্থনৈতিক কারণ
ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ ছিল নিম্নরূপ –
(১) সামন্তপ্রথার বিস্তার
একাদশ শতকে ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা প্রাচ্যে ভূখণ্ড দখল করে সামন্তপ্রথার বিস্তারে উদ্যোগী হন। তারা সেখানে সামন্তপ্রথা প্রবর্তন ও পরাজিতদের শোষণের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্রুসেডে যোগ দেন।
(২) অভিজাতদের লোভ
যে সমস্ত অভিজাতদের ম্যানরের আয় কমে গিয়েছিল, তারা এবং লোভী অভিজাতরা লুঠতরাজের মাধ্যমে ধন উপার্জনের লক্ষ্যে ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল।
(৩) বাণিজ্যিক স্বার্থ
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান বণিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরিস্থিতি বদলায়। নর্ম্যানরা মুসলমানদের কাছ থেকে সিসিলি কেড়ে নেয় এবং খ্রিস্টান শক্তি স্পেন অধিকার করে। ইটালির বণিকরা প্রাচ্য দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
(ঘ) সামাজিক কারণ
ক্রুসেডের সামাজিক কারণ ছিল নিম্নরূপ –
(১) ভূমিদাসদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা
ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করলে ভূমিদাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার ও ঋণগ্রহণকারীদের সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাই ক্রুসেডে যোগ দিয়ে ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল হাজার হাজার সার্ফ বা ভূমিদাস।
(২) জনসংখ্যার আধিক্য
মধ্যযুগে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে জমির পরিমাণ বাড়ে নি। ফলে জমির ওপর নির্ভরশীলদের একাংশ নতুন ভূখন্ডে শান্তিতে বসবাসের লক্ষ্যে ক্রুসেডের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করে।
(৩) তীর্থযাত্রীদের ক্ষোভ
একাদশ শতকে জেরুজালেম সেলজুক তুর্কিদের অধিকৃত হওয়ার পরও বহু খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী জেরুজালেম ভ্রমণে আসতে থাকেন। তীর্থযাত্রাকালীন তাদের অনেকেই দস্যুদের কবলে পড়েন ও আক্রান্ত হন। ফলে খ্রিস্টানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
উপসংহার:- জেরুজালেমের দখলকে কেন্দ্র করে ক্রুসেড শুরু হলেও তা শেষপর্যন্ত খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে অলক্ষ্যে এক সম্পর্ক গড়ে দেয়। এই সম্পর্কের সুবাদে প্রতীচ্য বা পশ্চিম ইউরোপীয় এবং প্রাচ্য বা ইসলামীয় সভ্যতার বিভিন্ন দিকগুলির আদান-প্রদান ঘটে।