পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল আলোচনা

উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায় – ঔপনিবেশিক ভারতের শাসন হতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করা হল।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল আলোচনা

প্রশ্ন:- পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ এর ফলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। প্রায় এক বছর ধরে দাপিয়ে এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। বাংলার মানুষ অনাহারে, অপুষ্টিতে কোনো খাবার খেতে না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

পঞ্চাশের মন্বন্তর

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর বাংলা সাল অনুযায়ী ১৩৫০ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হওয়ায় একে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ সমূহ

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের মদতে ইতিহাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু অন্যান্য বহু তথ্যের নিরিখে পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে সমস্ত সম্ভাব্য কারণ গুলি খুঁজে পাওয়া যায় সেগুলি হল –

(i) খাদ্য সংকট

অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে সীমিত আকারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে বাংলার মানুষের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। তারা আরও হতদরিদ্র হয়ে পড়ে।

(ii) খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস

ঘূর্ণিঝড়, জলস্রোত, ধানের মড়ক, উদ্বৃত্ত শস্যের অভাব প্রভৃতি কারণে পঞ্চাশের মন্বন্তরের আগে বাংলায় ধানের উৎপাদন বিগত ১০ বছরের তুলনায় খুবই কম পরিমাণে হয়েছিল। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে এর পরিণাম ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

(iii) খাদ্য সরবরাহ হ্রাস

পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় খাদ্যের চাহিদার তুলনায় খাদ্যের জোগানে ঘাটতি দেখা যায়। তাছাড়া এই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত গ্রাম গুলিতে খাদ্য দ্রব্য পাঠানো দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।

(iv) জাপানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কা

ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় আসন্ন জাপান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সরকার ‘পোড়ামাটি নীতি’ নিয়ে নৌকা, মোটরযান, গরুর গাড়ি সবকিছু ধ্বংস করলে বাংলায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। যা খাদ্য সঙ্কটকে আরও তীব্র করে।

(v) সরকারের নীতি

পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় সরকার অন্য প্রদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে খাদ্য সংকটের মোকাবিলা করতে পারতো কিন্তু তারা তা করেনি। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা খাদ্য রপ্তানিতে উদ্যোগী হলেও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বাণিজ্য গন্ডির কারণে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়।

(vi) চার্চিলের ভূমিকা

বাংলার চরম দুর্যোগের দিনে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা খাদ্যশস্য পূর্ণ জাহাজ ভারতে পাঠাতে চাইলেও যুদ্ধের কারনে জাহাজ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে চার্চিল খাদ্য পরিবহণের জন্য কোনো জাহাজ ছাড়তে রাজি হয়নি। চার্চিলের এই অমানবিক মনোভাব খাদ্য সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

(vii) মজুতদারি

ভারতে আসন্ন জাপান আক্রমণের ভয়ে সেনাদলের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগান রাখার উদ্দেশ্যে সরকার প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুত করে রেখেছিল। অন্যদিকে আগাম খাদ্য সংকটের আভাস পেয়ে বহু ব্যবসায়ীও  প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য কিনে নিজের গুদামে মজুত করে রাখে। সরকার বেআইনীভাবে মজুত করা এই খাদ্যের বন্টনের কোনো ব্যবস্থা করেনি। ফলে খাদ্য সংকট চরমে ওঠে।

(viii) খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি

এই সময় বাংলায় খাদ্য সঙ্কটের তীব্রতায় খাদ্যশস্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। এর ফলে গ্রাম বাংলার মানুষ খাদ্য ক্রয় করতে না পেরে, অভুক্ত হয়ে থাকে।

(ix) সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতা

ইতিপূর্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সময় সরকার বাইরে থেকে খাদ্য এনে সরবরাহ করত। কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় বাংলায় তারা সেরূপ ভূমিকা নেয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও জাতীয় নেতারা দুর্ভিক্ষের হুঁশিয়ারি দিলেও সরকার আদৌও কর্ণপাত করে নি।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চাশের মন্বন্তর এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। মানুষ খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে নিজের পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তানকে হত্যা করতে বাধ্য হতো। যার ফলে গ্রামের পর গ্রাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুর শ্মশানে পরিণত হয় গ্রামের পর গ্রাম। সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করার জন্য কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেয়নি। ফলত ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মন্বন্তর চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য,  কলকাতার ফুটপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলি কিছুটা প্রচার পেলেও গ্রাম বাংলার মৃত্যু গুলি ঘটেছে নীরবে, নিঃশব্দে।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ঘটা পঞ্চাশের মন্বন্তরের চিত্রটি খুবই দুঃখজনক ও মর্মভেদী। এই মন্বন্তরের একাধিক ফল লক্ষণীয় ছিল। যথা –

(i) মৃত্যুর মিছিল

পঞ্চাশের মন্বন্তরে অনাহারে প্রায় ৪০-৭০ লক্ষেরও বেশী মানুষ মারা যায়। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে মৃতদেহ স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

(ii) মানবিক বিপর্যয়

দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্ত মানুষ অখাদ্য পশুর মাংস, এমনকি কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে ডাস্টবিন থেকে খাবার নিয়ে খেত। সামান্য খাবারের জন্য ও তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর জন্য মানুষ যেকোনো কাজ করতে রাজি ছিল। কখনো আবার মানুষ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেত খাবারের সন্ধানে।

(iii) অর্থনৈতিক বিপর্যয়

দরিদ্র মানুষ তার সহায় সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে খাদ্য ক্রয় করে নিজের জীবন বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই অর্থ দিয়ে সামান্য পরিমাণ খাদ্য কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলে মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিকে জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন হিসাবে বেছে নেয়।

(iv) খাদ্য সরবরাহ

দেরিতে হলেও মন্বন্তরের পরিনাম দেখে সরকার দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য শহরে কয়েকটি ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলে। যেখানে স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী মিলতে শুরু করে। তাছাড়া সরকার ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে খাদ্য আমদানি করতেও শুরু করে।

(v) কমিশন গঠন

দুর্ভিক্ষের পর সরকার দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধান ও দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা নির্ধারণ করার জন্য ‘দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন’ গঠন করেছিল। এই কমিশন তার অনুসন্ধান চালানোর পর সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক রিপোর্ট পেশ করেছিল।

(vi) শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি

পঞ্চাশের মন্বন্তর কে উদ্দেশ্য করে একাধিক শিল্প ও সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন – বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ , অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘আকালের সন্ধানে’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বেশ কিছু চিত্রে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুন কাহিনী ধরা পড়ে।

উপসংহার :- পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা আজও চলছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এই সময়ের ঘটনা ও তথ্য অনুসরণে পরবর্তীকালে দেশে কোনাে বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করলে হয়তাে আর একটি “আনন্দমঠ’ সৃষ্টি হবে।

Leave a Comment