উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস অষ্টম অধ্যায়: অব-উপনিবেশীকরণ হতে সার্ক কীভাবে গঠিত হয়েছিল ও সার্কের উদ্দেশ্য কী ছিল তা আলোচনা করা হল।
সার্ক কীভাবে গঠিত হয়েছিল? সার্কের উদ্দেশ্য কী?
প্রশ্ন:- সার্ক কীভাবে গঠিত হয়েছিল? সার্কের উদ্দেশ্য কী ছিল? (HS History Question Paper 2016)
সূচনা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর অবসান ও অব উপনিবেশিকরণের সূচনা লগ্ন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত হয় সার্ক।
সার্ক
১৯৮০ -র দশকের গোড়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কগণ তাদের রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের পূর্ণব্যবহার দ্বারা সামগ্রিক বিকাশের লক্ষ্যে নানান ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলন। যার ফলশ্রুতি ছিল ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সার্ক।
সার্কের গঠন প্রক্রিয়া
সার্ক গঠনের প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত ভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। –
এশিয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলন
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত -এর রাজধানী দিল্লিতে আয়োজিত হয় এশিয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেখানে তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবর্গ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের স্বার্থে একটি আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা চিন্তা করেন।
বাংলাদেশের উদ্যোগ
বাংলাদেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সার্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ -এর প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন পূর্ব পাকিস্তান -এ মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার মঞ্চ গঠনের ভাবনা উদয় হয়।
বাগুইয়ো সম্মেলন
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপিন্সের বাগুইয়ো সম্মেলন এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত কলম্বো সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জোট সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
১৯৭০-এর দশকে রাজনৈতিক দোলাচল
১৯৭০ -এর দশকে এশিয়ার দেশগুলিতে বিভিন্ন ঘটনা দেখা যায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিণত হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় ভারতীয় রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বিকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলি সার্ক গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
সার্ক প্রতিষ্ঠা
সার্ক প্রতিষ্ঠায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কা সফরের সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোপারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ– এই সাতটি দেশের বিদেশমন্ত্রীগণ সার্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানের সভাপতিত্বে গড়ে ওঠে সার্ক।
সার্কের বর্তমান সদস্য রাষ্ট্র
- (i) ভারত,
- (ii) বাংলাদেশ,
- (iii) পাকিস্তান,
- (iv) শ্রীলঙ্কা,
- (v) নেপাল,
- (vi) ভুটান,
- (vii) মালদ্বীপ,
- (viii) আফগানিস্তান।
সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য
বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সার্ক গঠিত হয়েছিল। যেমন –
(১) জনকল্যাণ
দক্ষিণ এশিয়ায় জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, তাদের কল্যাণ সাধন এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ সাধন করাই ছিল সার্কের প্রধান লক্ষ্য।
(২) আত্মনির্ভরতা সৃষ্টি
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলি ছিল সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত। তাই এর অধিবাসীদের মধ্যে থেকে পরাধীনভূত স্বতন্ত্র মনোভাব দূর করতে সার্কের সদস্যগণ পারস্পরিক নির্ভরতার পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধির প্রতি নজর দিয়েছিল।
(৩) বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে সহায়তা
প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করাই ছিল সার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য।
(৪) যোগাযোগ বৃদ্ধি ও তথ্য বিনিময়
সার্কের লক্ষ্য ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা এবং সার্কের সদস্যদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করা।
(৫) পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি
এই সংগঠনের সদস্য রাষ্ট্র গুলির লক্ষ্য ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে তারা একে অপরের সমস্য সমাধান করতে পারবে।
(৬) সম অধিকার প্রদান
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি বিধানের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমাজে সমান অধিকার দান এবং তাদের নিজস্ব ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে সুযোগ প্রদান করাই ছিল সার্কের উদ্দেশ্য।
(৭) সহযােগিতা
সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধি করা। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গেও এই সহযােগিতার সম্পর্ক গড়ে তােলা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
(৮) নিরাপত্তা বিধান
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরােধ করা।
(৯) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখাও ছিল সার্কের লক্ষ্য।
উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে এই সকল লক্ষ্য পূরণের জন্য সার্কের সদস্য রাষ্ট্র সমূহ বেশ কিছু ক্ষেত্র নির্বাচন করেছিল। যেমন – কৃষি ও বনভূমি, সাস্থ ও জনকল্যাণ, গ্রামীণ বিকাশ, পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, নারী উন্নয়ন প্রভৃতি। তবে ভবিষ্যতে এই সকল ক্ষেত্রে সার্কের পরিকল্পনা যে সফল হয়েছে তা বলা যায় না।