উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সিলেবাস (তৃতীয় অধ্যায়) ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃতিঃ নিয়মিত ও অনিয়মিত সাম্রাজ্য হতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি লেখো। ভারতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব আলোচনা করা হল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্ত ও ভারতীয় অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব
প্রশ্ন:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি লেখো। ভারতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব লেখো। 4+4
উত্তর:- দেওয়ানি লাভের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ দিতে চাইলে ইংল্যান্ডের বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি জান্ট্রাস ও প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তা অনুমোদন করেন। ফলে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে দশসালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান শর্ত
এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান শর্তগুলি হল –
(১) বংশানুক্রমিক জমির স্বত্ব
বংশপরম্পরায় জমি ভোগদখল করে আসছে এরূপ জমিদাররা বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে খাজনা দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জমির স্বত্ব ভোগ করতে পারবে।
(২) রাজস্ব আদায়
জমিদাররা ও ইজারাদাররা আদায় করা রাজস্বের ১০ ভাগ সরকারি কোশাগারে জমা দেবে এবং এক ভাগ নিজেরা ভোগ করবে।
(৩) সূর্যাস্ত আইন
সূর্যাস্ত আইন অনুসারে বাংলা সালের হিসেবে বছরের শেষ দিনে সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বেই বাকি রাজস্ব জমা করতে হবে, না হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।
(৪) রাজস্বে ছাড় নেই
অদূর ভবিষ্যতে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও রাজস্বের ছাড় দেওয়া হবে না।
(৫) ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত বিবাদের বিচার
জমিদাররা ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত কোনো বিবাদের বিচার করার অধিকার পাবে না।
(৬) রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত
ভবিষ্যতে জমিদারদের আয় বাড়লেও কোম্পানির আদায় করা নির্ধারিত রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে।
ভারতীয় অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যেমন –
(১) জমির স্বত্ব দান
জমির ওপর জমিদারদের স্বত্ব দান করায় জমিদাররা আরও বেশি করে কৃষিব্যবস্থায় মূলধন বিনিয়োগ করে কৃষিকাজের সম্প্রসারণ ঘটানোর চেষ্টা করে।
(২) কৃষকবিদ্রোহ
বিভিন্ন মধ্যস্বত্ব ও উপস্বত্বভোগীরা অধিক খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে কৃষক শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এরা নির্ধারিত খাজনা ছাড়াও বিভিন্ন বেআইনি কাজ থেকে খাজনা আদায় করে। ফলে কৃষক সমাজে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্মায় তারই অনিবার্য পরিণতি উনিশ শতকে সংঘটিত একের পর এক কৃষকবিদ্রোহ।
(৩) জমিদারির অবসান
বছরের শেষে চড়া রাজস্ব শোধ করা অনেক জমিদারের পক্ষেই সম্ভব হত না। ফলে, সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিন অতিক্রান্ত হওয়ায় বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারান। এইভাবেই রাজশাহী, দিনাজপুর, নদিয়া, বীরভূমের জমিদারির অবসান ঘটে।
(৪) মধ্য ও উপস্বত্বভোগীর উদ্ভব
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ইজারাদার, দর-ইজারাদার, পত্তনিদার, প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর উদ্ভব ঘটে। কোম্পানির সঙ্গে জমিদারের যেমন চুক্তি হত, তেমনি জমিদারদের সঙ্গেও মধ্যস্বত্বভোগীদের চুক্তি সম্পাদিত হত।
(৫) কৃষকদের দূরবস্থা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছিল কৃষকদের। কারণ জমির ওপর জমিদাররা মালিকানা স্বত্ব পেলেও কৃষকরা তা পায় নি। জমিদার খেয়ালখুশি মতো কৃষক প্রজাকে তার জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন।
(৬) গ্রামীণ পরিকাঠামোর ভাঙন
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। মধ্যস্বত্বভোগী সুদখোর ও মহাজনরা মিলে গ্রামীণ কৃষিজ অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়।
(৭) মহাজনশ্রেণির আবির্ভাব
মধ্যস্বত্বভোগীরা রাজস্ব আদায়ের নামে কৃষক প্রজাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু করে। কৃষকরা বাধ্য হয় মহাজনশ্রেণির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে। সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট দেনার পরিমাণ যা দাঁড়াত তা কখনোই কৃষক প্রজারা শোধ করতে পারত না। ফলে মহাজনরা তাদের সর্বস্ব গ্রাস করে নিত।
(৮) ব্রিটিশ অনুগত সম্প্রদায়ের উদ্ভব
সূর্যাস্ত আইনের শিকার হয়ে যেসব জমিদার জমিদারি হারান, তাদের জমিদারি ক্রয় করে নতুন এক জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার, রানাঘাটের পালচৌধুরী পরিবার, কাশিমবাজারের নন্দী পরিবার, শোভাবাজারের দেব পরিবার প্রভৃতি।
উপসংহার:- ড. তারা চাঁদ মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতের সামাজিক সংগঠন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। ভারতের চিরাচরিত গ্রামীণ সংগঠন ধ্বংস হয়, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে, নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিপ্লব ঘটে।