উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আদিম মানব থেকে প্রাচীন সভ্যতাসমূহ’ থেকে মধ্য প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল ।
মধ্য প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির আলোচনা
প্রশ্ন:- মধ্য প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
ভূমিকা :- প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ প্রথম থেকে বিভিন্ন ধরনের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে খাদ্যের সংস্থান করতো। তাই এই যুগকে প্রস্তর যুগ বলা হত। তিনটি প্রস্তর যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল হল মধ্যপ্রস্তর যুগ।
প্রেক্ষাপট
প্লেইস্টোসিন যুগের শেষ দিকে চতুর্থ অর্থাৎ সর্বশেষ বরফের যুগের অবসানের পর ভূপ্রকৃতিতে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসে। এই যুগ শেষ হলে জলবায়ু উষ্ণ ও বর্ষনমুখর হয়ে ওঠে। বরফের আস্তরণ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
মানব সমাজ এই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, ঘন গাছপালা এবং গভীর অরণ্যের সুযোগ গ্রহণ করে। ইউরোপের তুন্দ্রা অঞ্চল এই সময় বনভূমিতে ছেয়ে যায়। নিকট প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ মাঠ-ঘাটগুলি মরুভূমিতে পরিণত হয়। নতুন এই আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে এই যুগে বেশ কিছু প্রাণী ও মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
সময়কাল
খাদ্য সংগ্রহকারী প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও খাদ্য উৎপাদনকারী নব্যপ্রস্তর যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল মধ্য প্রস্তরযুগ নামে চিহ্নিত। এই যুগের সময়সীমা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ অব্দ পর্যন্ত মধ্য প্রস্তর যুগ বিস্তৃত ছিল।
হাতিয়ার
মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ হাতিয়ার তৈরিতে আরো দক্ষতার পরিচয় দেয়। এই যুগের হাতিয়ার পূর্ববর্তী যুগের থেকে উন্নত ও আকারে ক্ষুদ্র হয়। জীবজন্তুর হাড় ও দাঁত দিয়ে হাতিয়ার তৈরির কাজ এই সময় আরো উন্নত হয়। এই যুগে মানুষের প্রধান অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক, হারপুন, বর্শা। হাতিয়ারের ক্ষুদ্র আকারের জন্য এই যুগকে ‘ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগ’ নামেও অভিহিত করা হয়।
জীবিকা
মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল পশুশিকার ও ফলমূল সংগ্রহ। বড়ো পশুর পাশাপাশি তারা লাল হরিণ, বনবেড়াল, নেউল ইত্যাদি পশুও শিকার করত। যারা নদী ও সমুদ্রের উপকূলে বাস করত তারা সেখান থেকে মাছ ও শামুক সংগ্রহ করত। এই যুগের মানুষ কোনো কোনো পশুকে পোষ মানাতেও শেখে।
খাদ্য
মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল বনের ফলমূল, হরিণ, শূকর, গােরু, ভেড়া, প্রভৃতি পশুর মাংস, মাছ ও শামুক।
পোশাক-পরিচ্ছদ
মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষগাছের ছাল ও পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করে জীবন অতিবাহিত করতো।
বাসগৃহ
পুরা প্রস্তর যুগের তুলনায় কিছুটা উন্নত মানের বসতি নির্মাণ করে মধ্যপ্রস্তর যুগেরমানুষ নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করত।
ধর্মীয় জীবন
মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ধর্মীয় কারণে কোনো অলৌকিক শক্তিকে প্রসন্ন করার জন্য গুহার দেওয়ালেচতুষ্কোণ, ত্রিকোণ, বৃত্তাকার চিত্র আঁকত।
যানবাহন
বরফের উপর দিয়ে চলার জন্য মধ্যপ্রস্তর যুগের আদিম মানুষ শ্লেজ গাড়ির ব্যবহারও জানত। এই গাড়ি টানার কাজে তারা কুকুরকে কাজে লাগাত। তারা জলপথে যাতায়াতের উদ্দেশ্যে গাছের গুঁড়ি খোদাই করে নৌকা বানাত।
চিত্রকলা
মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ চিত্রকলায় কিছুটা অগ্রগতি ঘটায়। নিত্য দিনের ব্যবহার্য সামগ্রী ও বিভিন্ন হাতিয়ার ছিল এই যুগের চিত্রকলার বিষয়বস্তু। জ্যামিতিক আকারে ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ, বৃত্তাকার চিত্র এই সময় আঁকা হত। মানুষ ও পশুর চিত্রও পাওয়া গেছে সুইডেন, ফিনল্যাণ্ড, রাশিয়ার বিভিন্ন গুহায়।
ভারতে মধ্য প্রস্তর যুগ
ভারতে মধ্য প্রস্তর যুগের অনেক ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন – রাজস্থান, দক্ষিণ উত্তর প্রদেশ, মধ্য ও পূর্বভারত এবং কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে। এদের মধ্যে রাজস্থানের বাগর অঞ্চলে এই সভ্যতার নিদর্শন অত্যন্ত স্পষ্ট। এখানে ছোটো হাতিয়ারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এখানকার অধিবাসীরা শিকার ও পশুপালনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই যুগের সংস্কৃতি নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির আবির্ভাবের পথ সুগম করেছিল।
উপসংহার :- মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির সময়কাল স্বল্প কিন্তু সংস্কৃতির পরিবর্তন ছিল তাৎপর্যবহ। প্রস্তর যুগ থেকে সভ্যতার পথে অগ্রসর হওয়ার এই পর্বকে সভ্যতার উষালগ্ন বলা যায়। মধ্য প্রস্তর যুগের বিবর্তন ব্যতিরেকে পরবর্তী নব্য প্রস্তর যুগ অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য।
মধ্য প্রস্তর যুগের গুহাশিল্প