উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আদিম মানব থেকে প্রাচীন সভ্যতাসমূহ’ থেকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার শিল্প সংস্কৃতির মূল্যায়ন সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার শিল্প সংস্কৃতির মূল্যায়ন
প্রশ্ন:- প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার শিল্প সংস্কৃতির মূল্যায়ন করো।
ভূমিকা :- আদিম মানবসভ্যতায় পশুপালন ও খাদ্যসংগ্রহকারী জীবন থেকে কৃষিজীবী জীবনে উত্তরণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হল মিশর দেশ। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বর্তমানে সম্মিলিত আরব যুক্তরাষ্ট্র এলাকায় প্রাচীন মিশর দেশ গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার শিল্প ও সংস্কৃতি ছিল যথেষ্ট উন্নতমানের।
স্থাপত্য ভাষ্কর্য
প্রাচীন মিশরের শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন ছিল স্থাপত্য ভাষ্কর্য। মিশরে স্থাপত্য বলতে বিভিন্ন আকারের পিরামিডের কথা বলা হয়ে থাকে। পিরামিড হল পাথরের তৈরি বিশালাকার সমাধি মন্দির। ফ্যারাও খুফু পিরামিডের আকারেই একটি দর্শনীয় স্ফিংস নির্মাণ করেন। এখানকার সবচেয়ে বড়ো পিরামিডটি তৈরি করেন খুফু।
লিপি
মেসোপটেমিয়ার মতো মিশরে প্রথমে চিত্রলিপির প্রচলন ছিল। তারা চিত্র এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিপিকে বলা হয় হায়ারোগ্লিফিক। গ্রিক ভাষায় এর অর্থ হল ‘পবিত্র লিপি’। মন্দির বা কবরের গায়ে এই লিপি খোদাই করা হত। ধীরে ধীরে এক একটি শব্দ বোঝানোর জন্য নির্দিষ্ট চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়। লেখার জন্য তারা ব্যবহার করত প্যাপিরাস নামক গাছের ছাল।
চিত্রকলা
চিত্রশিল্পে প্রাচীন মিশর যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছিল। মিশরের প্রথম ফ্যারও মেনেসের আমল থেকেই এদেশে বিভিন্ন শিল্প কলার উৎকর্ষ লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন অট্টালিকা ও মন্দিরের দেওয়ালে নানান ধরনের চিত্র অঙ্কন করা হত। এই অঙ্কনের বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাচ, গান, রাজপরিবার, রাজা, প্রজা ও ক্রীতদাসদের বিভিন্ন দৃশ্য।
সাহিত্য চর্চা
প্রাচীন মিশরীয়রা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেওঅগ্রগতির নজির সৃষ্টি করেছিলেন। তারা গদ্যসাহিত্য ও কাব্য উভয় বিষয় চর্চা করত। তাদের সাহিত্যচর্চার অন্যতম নিদর্শন হল পঞ্চম ও ষষ্ঠ রাজবংশের আমলে পিরামিড ও মন্দিরের গায়ে খোদাই করা নানান লিপি। তাদের ধর্মীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনছিল মৃতদের পুস্তক।
বিজ্ঞান চর্চা
প্রাচীন মিশরে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতি ঘটেছিল। এখানকার পুরোহিতরা বর্ষপঞ্জি তৈরি করতেন মানবদেহে নাড়ির স্পন্দন হৃদপিন্ডের ভূমিকা গাছপালার ভেষজ গুণাবলী শল্যচিকিৎসায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রকৃতি মিশরীয় জানতেন।
শিক্ষা
প্রাচীন মিশরের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অবৈতনিক। শুধু যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীরাই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে পারত। মূলত উচ্চ সম্প্রদায়ের মধ্যেই লেখাপড়ার বা বিদ্যাচর্চার প্রচলন ছিল। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পুরোহিতদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তারা মন্দির প্রাঙ্গনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করত।
ধর্মবিশ্বাস
মিশরীয়রা ছিল প্রকৃতির উপাসক। তারা মনে করত প্রকৃতির দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বস্তুর মাঝেই ঈশ্বর আছেন। তাই তারা আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়, নদ-নদী সবকিছুকেই দেবতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করত। তারা মনে করত যে, দেবতারা পশুপাখি বা বৃক্ষরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তাদের প্রধান দেবতা ছিলেন ‘রা’, “আমন এবং ‘আসিরিস’। এদের মধ্যে সূর্যের দেবতা ‘রা’ ছিলেন সর্বপ্রধান।
মমি
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, মৃত্যুর পরেও এক জীবন থাকে। মৃতদেহের মধ্যেই আত্মা বেঁচে থাকে। তাই তারা এই বিশ্বাস থেকে মৃতদেহগুলিকে সুগন্ধি দ্রব্য ও রাসায়নিক দ্রব্য মাখিয়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে সংরক্ষণ করে রাখত। এই সংরক্ষণ করা মৃতদেহকে বলা হয় মমি।
পিরামিড
বিভিন্ন রাজা ও ধনী ব্যক্তির মৃতদেহের পাশে তার প্রিয় খাবার, আসবাবপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রভৃতি রেখে তার উপর পাথর সাজিয়ে ত্রিকোণাকৃতির অট্টালিকা তৈরি করা হত। একেই বলা হতো পিরামিড।
নোক্রোপোলিস
মিশরীয়দের রাজ পরিবারের সদস্যদের সমাধিস্থলকে মৃত্যুপুরী বা নেক্রোপোলিস বলা হত। মিশরের রাজাদের সমাধিস্থলকে ভ্যালি অফ কিংস এবং রানীদের সমাধিস্থলকে বলা হতো ভ্যালি অফ কুইন্স। এই সময়ে নির্মিত নেফারতিতির সমাধিটি সবথেকে বড় বলে জানা যায়।
উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে, শিল্প সংস্কৃতি ইতিহাসে মিশর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।পরবর্তীকালে প্রতিবেশী দেশগুলি তাদের শিল্প সংস্কৃতিকে অনুসরণ করেছিল। এছাড়া রোমের শিল্প সংস্কৃতিতেও মিশরীয় শিল্প সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।