উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় ‘রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং তার শাসন যন্ত্র’ থেকে পারস্যের ক্ষত্রপ ও চীনের ম্যান্ডারিন -এর বর্ণনা দাও
পারস্যের ক্ষত্রপ ও চীনের ম্যান্ডারিন -এর বর্ণনা দাও
প্রশ্ন:- পারস্যের ক্ষত্রপ ও চীনের ম্যান্ডারিন -এর বর্ণনা দাও।
ভূমিকা:- পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষত্রপদের এবং সাম্রাজ্যবাদী চিনের আমলা হিসেবে পরিচিত ছিল ম্যাণ্ডারিনরা।
পারস্যের ক্ষত্রপ
পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্য বৃহৎ ও ক্ষুদ্র কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল যেগুলির নাম ছিল স্যাট্রাপি। স্যাট্রাপিগুলির শাসনকর্তা ছিলেন স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ, যারা রাজার কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন।
(১) অর্থ
প্রাচীন পারসিক অর্থে স্যাট্রাপ বলতে সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তাকে বোঝাত। এক কথায়, আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক বিভাগ ছিল স্যাট্রাপি আর এই বিভাগের প্রধান ছিলেন স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ।
(২) উৎস
‘Satrap’ শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে গ্রিক শব্দ ‘Satrapia’ থেকে। Satrapy শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রদেশ। আর Satrap শব্দের আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা।
(৩) আত্মপ্রকাশ
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই পারসিক সম্রাট কাইরাস আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার সাম্রাজ্যে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ফলে প্রদেশ বা সাট্র্যাপিগুলিতে ক্ষত্রপ স্যাট্রাপদের নিয়োগ করা শুরু হয়।
(৪) কার্যাবলি
স্যাট্রাপির প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষত্রপ স্যাট্রাপদের বেশকিছু কাজ করতে হত। যেমন –
(ক) কর আদায়
কর আদায় করা ও তা সরকারি কোশাগারে জমা দেওয়া।
(খ) সেনা নিয়োগ
যুদ্ধে পারদর্শী ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা।
(গ) আমলা নিয়োগ
আঞ্চলিক প্রশাসনিক স্তরে আমলাদের নিয়োগ করা।
(ঘ) বিদ্রোহ দমন
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহগুলির অবসান ঘটানো।
(ঙ) সমস্যার মোকাবিলা
প্রদেশগুলির বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বা নানাবিধ সমস্যার মোকাবিলা করা।
(চ) বৈদেশিক আক্রমণ রোধ
বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা।
(ছ) সমরবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ
সামরিক শক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করা।
(জ) বিচারকার্য
স্যাট্রাপ ছিলেন প্রদেশের বিচার বিভাগের প্রধান। পৌর এবং ফৌজদারি অপরাধের তিনি বিচার করতেন।
(ঝ) বাৎসরিক খতিয়ান পেশ
সঠিক সময়ে খতিয়ান পেশ-এ ব্যর্থ হলে স্যাট্রাপদের মহান রাজা প্রথমে সতর্ক করতেন এবং পরে তার পদ কেড়ে নিতেন।
(৫) ক্ষত্রপের সঙ্গে সম্রাটের দায়বদ্ধতার সম্পর্ক
পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশে নিয়োজিত ক্ষত্রপ বা স্যাট্রাপগণ ছিলেন মূলত সম্রাটের প্রতিনিধি। তারা নিজেদের কাজের জন্য সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।
(৬) প্রতিনিধিত্ব
সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং রাজকীয় কর্তৃত্ব পালনের মধ্যে দিয়েই ক্ষত্রপরা নিজেদেরকে সম্রাটের সফল প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন।
(৭) নিয়োগ ও পদচ্যুতিগত
নিয়োগ থেকে শুরু করে পদচ্যুতি পর্যন্ত ক্ষত্রপ বা স্যাট্রাপদের ভাগ্য নির্ভরশীল ছিল সম্রাটের ওপর। দায়িত্বে অবহেলা দেখালে তারা সম্রাট কর্তৃক পদচ্যুত হতেন।
(৮) স্যাট্রাপগুলির বিদ্রোহ
পরবর্তী সময়ে পারস্যের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে সেই সুযোগে বিভিন্ন পারসিক স্যাট্রাপির শাসক স্যাট্রাপগণ স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠেন। পারসিক সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপ ও তৃতীয় আলেকজান্ডারের শাসনকালে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে স্যাট্রাপগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
চিনের ম্যান্ডারিন
ম্যান্ডারিনরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী চিনের আমলা। চিনা শাসনতন্ত্রে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তারা সম্রাটের সহযোগী ছিলেন।
(১) ম্যান্ডারিনদের যোগ্যতা
চিনা উচ্চপদস্থ আমলা অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের বেশ কিছু যোগ্যতার অধিকারী হতে হত। যেমন –
(ক) প্রশাসনিক দক্ষতা
ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীকে প্রশাসনের কাজ চালানোর মতো দক্ষতা দেখাতে হত।
(খ) শিক্ষাদীক্ষা
নিয়োগের আগে ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর শিক্ষাদীক্ষা বিচার করা হত।
(গ) রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা
প্রার্থী ইতিপূর্বে স্থানীয় বা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত থেকে কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন কি না তাও দেখা হত।
(ঘ) ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্যের ধারণা
ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার ছিল।
(২) নিয়োগ
ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের নিয়োগ করার আগে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা নেওয়া হত। এই পরীক্ষায় কনফুসীও আদর্শ, তাওবাদ, সাহিত্য, কাব্য, সাধারণজ্ঞান, রাজনীতি এবং ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা হত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের প্রথমে স্থানীয়, প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করা হত। সাধারণত ম্যান্ডারিনদের একই জায়গায় দীর্ঘদিন না রেখে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে দেওয়া হত।
(৩) পদচ্যুতি
ম্যান্ডারিনরা তাদের কাজে অবহেলা দেখালে বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে বা সাম্রাজ্য বিরোধী কাজে লিপ্ত হলে প্রমাণ সাপেক্ষে তারা সম্রাট কর্তৃক পদচ্যুত হতেন।
(৪) মর্যাদা
চিনের সমাজে উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনরা যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষত চিনের কিং বংশের রাজাদের আমলে চিনের সমাজে রাজপরিবার ও প্রধানমন্ত্রীর পরেই মর্যাদা ভোগ করতেন উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনরা। উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ মূল্যবান ধাতুর অলংকারযুক্ত ও রত্নখচিত পোশাক পরতেন। তারা দামি পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি মাথায় দিতেন। মধ্য ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনগণও যথেষ্ট ব্যয়বহুল জীবন যাপন করতেন। তারাও জমকালো পোশাক পরতেন এবং প্রবাল, লাপিস-লাজুলি, সোনা, রুপা প্রভৃতি রত্নখচিত টুপি মাথায় দিতেন।
(৫) কার্যাবলি
চিনের ম্যান্ডারিনদের একাধিক কাজ করতে হত। যেমন –
(ক) প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্য
চিনের ম্যান্ডারিনরা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন।
(খ) রাজকার্যে সাহায্য
সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিনরা যেহেতু চিনা সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয় ছিলেন, তাই তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাজাকে সহায়তা করার সুযোগ পেতেন।
(গ) সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা
মধ্য ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনরা প্রদেশ বা স্থানীয় অঞ্চলগুলিতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেন।
(৬) গুরুত্ব
চিনের ম্যাণ্ডারিন ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(ক) প্রশাসনিক সাফল্য
চিনের প্রশাসনিক সাফল্য ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার ওপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল।
(খ) সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি
চিনের সাম্রাজ্যের যুগের স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ম্যান্ডারিনরা।
(গ) জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থান
চিনের সমাজে ম্যান্ডারিনরা বিশেষ সুবিধাভোগী এবং বিশিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই ম্যান্ডারিনদের থেকেই পরবর্তীকালে চিনে জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছিল।
উপসংহার :- পারস্যের ক্ষত্রপ ব্যবস্থা প্রথম দিকে সাফল্য লাভ করলেও পরবর্তী সময়ে এই ব্যবস্থার পতন ঘটে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিনে কিং বংশের পতন ঘটার পর সামগ্রিকভাবে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে।