উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় অতীত স্মরণ হতে অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা আলোচনা করা হল।
অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা
প্রশ্ন:- অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা আলোচনা কর। ৪+৪
উত্তর:-
লিজেন্ড বা কিংবদন্তি
কিংবদন্তির সংজ্ঞা
পাশ্চাত্য জগতে প্রচলিত লেজেন্ড, আঞ্চলিক ঐতিহ্য, জনপ্রিয় অ্যান্টিকুইটিস নামের আঙ্গিক কে বাংলায় কিংবদন্তি বলা হয়। আক্ষরিক অর্থে কিংবদন্তি বলতে বোঝায় আকর্ষণীয় গল্প গাথা যেখানে কল্পিত নায়ক কে বাস্তব চরিত্ররূপে উপস্থাপিত করা হয় এবং তার মধ্যে অতিমানবিক গুণাবলীর সমাবেশ ঘটানো হয়।
কিংবদন্তির উদাহরণ
রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, হারকিউলিস, গোপাল ভাঁড়ের কাহিনী ইত্যাদি।
কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য
কিংবদন্তির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য গুলি হল —
(ক) বিষয়বস্তু
ইতিহাস – নির্ভর কাহিনী, প্রেম – বিরহ সম্পর্কিত কাহিনী, আধ্যাত্মিক ঘটনা, পরিচিত বা ভূত – প্রেতের কাহিনী ইত্যাদির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের ঘটনা কিংবদন্তির বিষয়বস্তু হয়ে থাকে।
(খ) চরিত্রের অস্তিত্ব
একথা সাধারণ ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, কিংবদন্তির চরিত্র গুলি অতীত কালে এক সময় জীবিত ছিলেন। যেমন – রামচন্দ্র, হারকিউলিস প্রমুখ কিংবদন্তির চরিত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ প্রায় নিশ্চিত।
(গ) বিস্ময় ও কল্পনা
কিংবদন্তি হল ইতিহাসের অপক্ব ফসল। বিস্ময় ও কল্পনা কিংবদন্তির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সক্রিয়।
(ঘ) অতিরঞ্জন
অতীতের কোনো ব্যক্তির বাস্তব জীবনের সাথে বিভিন্ন অতিমানবীয়, অবিশ্বাস্য ও অতিরঞ্জিত ঘটনা যুক্ত হয়ে কিংবদন্তি রচিত হয়।
কিংবদন্তির গুরুত্ব
মৌখিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে কিংবদন্তির গুরুত্ব গুলি হল —
(ক) ঐতিহাসিক তথ্যের সূত্র
বিভিন্ন কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করা সম্ভব হয়। যেমন পূর্ব বঙ্গের সীতাকোট, বেহুলার বাসরঘর প্রভৃতি স্থান সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে।
(খ) আনন্দদান
কিংবদন্তির ঘটনা গুলি অতীত কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে লোক সমাজকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে।
(গ) শিক্ষাদান
কিংবদন্তির ঘটনা গুলি অতীতের নৈতিকতা, বীরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে বর্তমান কালের মানুষ কে শিক্ষা দিয়ে থাকে।
(ঘ) ঐতিহাসিক ভিত্তি
বহু ক্ষেত্রেই কিংবদন্তির কাহিনী গুলির একটি বাস্তব ভিত্তি আছে। যেমন বাংলার কিংবদন্তি চরিত্র রঘু ডাকাতের কালী পুজোর ভিত্তিতে আজও একটি কালী মন্দির কে চিহ্নিত করা হয়।
(ঙ) ধারাবাহিক অগ্ৰগতি
কিংবদন্তির কাহিনী লোকায়ত সংস্কৃতি ও ধ্যান ধারণার বাহক হিসেবে মানবসভ্যতার ধারাবাহিক অগ্ৰগতির সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্মৃতিকথা
স্মৃতিকথার সংজ্ঞা
স্মৃতি বলতে মনে রাখা বিষয়কে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে নিকট অতীতকে স্মরণ করা যায়। কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁর জীবনের ফেলে আসা সময়ের কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ বা প্রকাশ করে অতীতকে স্মরণ করে। এই অতীত স্মরণকেই বলা হয় স্মৃতিকথা।
অন্যভাবে বলা যায়, স্মৃতিকথা হল এক ধরণের সাহিত্য, যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে তুলে ধরেন।
স্মৃতিকথার উদাহরণ
জ্যোতি বসুর লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্ৰন্থ “যতদূর মনে পড়ে” ইংরেজ শাসন ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাস জানতে সাহায্য করে।
স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য
স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- (1) স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। স্থানীয় ইতিহাস লেখায় এটি বিশেষ উপযোগী।
- (2) স্মৃতিকথা কোন কাল্পনিক কাহিনি নয়। এর একটি বাস্তব ভিত্তি আছে।
- (3) স্মৃতিকথায় লেখকের সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোচনা থাকে না। থাকে জীবনকালে ঘটে যাওয়া সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার বিবরণ। যেমন, হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের “উদবাস্তু”। এখানে কেবল পশ্চিমবঙ্গের উদবাস্তুদের জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে।
- (4) লেখক এখানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকেন।
- (5) লেখক নিজে কাহিনির কথক হিসাবে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাই রচনার উপস্থাপনা হয় উত্তম পুরুষে।
- (6) স্মৃতিকথায় লেখকের কোন ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশিত হয়। যেমন, দক্ষিণারঞ্জন বসুর “ছেড়ে আসা গ্রাম” গ্রন্থে দেশভাগের যন্ত্রণার বিশেষ অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে।
স্মৃতিকথার গুরুত্ব
ভারতের ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য –
(1) গুণিজনদের লেখা তথ্য
স্মৃতিকথাগুলি অধিকাংশই গুণীজনদের লেখা। তাই তাতে অবান্তর,পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম থাক্বে।
(2) বাস্তবতা
স্মৃতিকথাগুলি কাল্পনিক বিষয় নয়। তাই এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়।
(3) প্রত্যক্ষ সাক্ষী
বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ঘটনার বিবরণ দেন। তাই উক্ত বিবরণে তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।
(4) স্থানীয় ইতিহাসের উপাদান
স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। স্থানীয় ইতিহাস লেখায় এটি বিশেষ উপযোগী।
উপসংহার:- সুতরাং বলা যায়, যেখানে লিখিত ইতিহাস পৌছাতে পারে না, সেখানেই কিংবদন্তি ও স্মৃতিকথার প্রয়োজন হয়। কিংবদন্তি ও স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।