উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আদিম মানব থেকে প্রাচীন সভ্যতাসমূহ’ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের জীবন যাত্রার পরিচয় দাও। এই যুগের গুরুত্ব কি?
নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের জীবন যাত্রার পরিচয় দাও। এই যুগের গুরুত্ব কি?
প্রশ্ন:- নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের জীবন যাত্রার পরিচয় দাও। এই যুগের গুরুত্ব কি?
ভূমিকা :- পাথরের যুগের শেষ পর্যায় নতুন পাথর বা নব্য প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত। মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির শেষে এই পর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এই অনুকূল পরিবেশে আদিম মানবের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়।
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রা
আনুমানিক ৮০০০-৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়কাল হল নতুন পাথরের যুগ। এই সময়ের মানুষের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) জীবিকা
এই যুগের মানুষ পশুপালনের কৌশল আয়ত্ত করে। কুকুর, ভেড়া, গোরু, গাধা, হাতি প্রভৃতি পশুকে তারা পোষ মানাতে শেখে। খাদ্যের জোগান ছাড়াও গৃহপালিত পশুকে তারা যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। নব্য প্রস্তর পর্বে আবাসস্থলের পাশে বীজ বা গাছের শিকড় পুঁতে দেওয়া শুরু হয়। এভাবেই কৃষির সূচনা ঘটে।
(২) সমাজ
পূর্বেকার সমাজকাঠামো এই যুগে আরও পরিশীলিত হয়। পরিবারগুলির কাঠামো আরও সুসংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। সমাজে একক বা দলগত বিবাহরীতি চালু হয়। সমাজে বিনিময়প্রথার উদ্ভব ঘটে এবং শ্রমবণ্টন ব্যবস্থা চালু হয়।
(৩) আবাসন
নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষ স্থায়ী আবাস নির্মাণ করতে শেখে। গাছের ডালপালা ও ঘাসপাতা দিয়ে তারা কুটির বানাতে শেখে। সুইটজারল্যান্ডের আদিম অধিবাসীরা হ্রদের মধ্যে খুঁটি পুঁতে তার ওপর মাচা বেঁধে বসবাস করত এমন নিদর্শন পাওয়া গেছে।
(৪) হাতিয়ার
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ আগের তুলনায় অনেক উন্নত মানের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল কাটারি, নিড়ানি, ছেনি, বাটালি, কাস্তে, বর্শার ফলা, ছোরা, ছুঁচ প্রভৃতি। কুঠার, কোদাল-সহ বেশ কিছু হাতিয়ারে কাঠের হাতল লাগানোর কৌশল এই সময় চালু হয়।
(৫) আগুনের ব্যবহার
নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ পাথর ভাঙার মধ্য দিয়ে প্রথম আগুন জ্বালানোর কৌশল আবিষ্কার করে। আগুনের সাহায্যে তারা কাঁচা মাংস আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে বা সেদ্ধ করে খেতে শেখে, গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে বুনো জন্তুদের তাড়াতে শেখে এবং শীতের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
(৬) চাকার আবিষ্কার
নব্য প্রস্তর যুগে এক তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হল ‘চাকা’। চাকার ব্যবহারের মাধ্যমে মৃৎপাত্র উৎপাদনে পরিবর্তন আসে, পাশাপাশি চাকাকে কাজে লাগিয়ে যানবাহন তৈরির ধারণা সৃষ্টি হয়।
(৭) ভাষার উন্নয়ন
নব্য প্রস্তর যুগে ভাষার উন্নতি ঘটেছিল। এই যুগে সমাজ কাঠামো অনেক সংঘবদ্ধ হওয়ায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছু ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
(৮) শিল্প
নব্য প্রস্তর যুগে বস্ত্রবয়ন শিল্পের সূচনা ঘটেছিল। শণের আঁশ থেকে তৈরি সুতো দিয়ে এসময়ের কারিগররা লিনেন কাপড় বুনতে শেখে। মেসোপটেমিয়ার কারিগররা ভেড়ার লোম দিয়ে পশমি কাপড় বানাতে শেখে। নব্য প্রস্তর যুগে মৃৎশিল্পে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। চাকাকে কাজে লাগিয়ে কম সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাটির পাত্র তৈরি হতে থাকে। মাটির তৈরি পাত্রকে পুড়িয়ে শক্ত করার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। পাত্রগুলির গায়ে নানা ধরনের নকশা এবং রং করার কৌশল চালু হয়।
(৯) শিল্পকলা ও ধর্মবিশ্বাস
নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ পাথর কেটে দেবীমূর্তি গড়তে শিখেছিল। মেসোপটেমিয়ার ইউবেইদ এবং ইজিয়ান সভ্যতার কীট-এ এই ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে।
নব্য প্রস্তর যুগের গুরুত্ব
বিভিন্ন দিক থেকে নব্য প্রস্তর যুগ ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
(১) কৃষিকাজের সূচনা
নব্য প্রস্তর যুগে কৃষি পদ্ধতির আবিষ্কার ঘটে। মানুষ এই সময় গম ও যবের চাষ করতে শেখে। ফলে এই যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়।
(২) পশুপালন
এই সময় কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালন শুরু হয়। বেশকিছু বন্যপশু এই সময় গৃহপালিত পশুতে পরিণত হয়। প্রথমদিকে কুকুর, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশুকে পোষ মানানো হয়।
(৩) স্থায়ী বসতি স্থাপন
কৃষিকাজ ও পশুপালনের ফলে মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ফলে গৃহনির্মাণ পদ্ধতির বিকাশ ঘটে এবং কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে।
(৪) ধাতুর ব্যবহার
নব্য প্রস্তর যুগের শেষদিকে ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। ফলে সভ্যতার দ্রুত অগ্রগতি ঘটে। এই সময় মানুষ তামা ও টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ ধাতু তৈরি করতে শেখে।
(৫) হাতিয়ারের উন্নতি
নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ারগুলির চরম উন্নতি সাধিত হয়। কাস্তে, কুঠার, জাঁতা, হামান, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র এই সময় তৈরি হয়। ব্রোঞ্জের তৈরি হাতিয়ারগুলি পাথরের হাতিয়ারের চেয়ে অনেক উন্নত ও মজবুত হয়। চাকা এই যুগের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার।
(৬) সাংস্কৃতিক অগ্রগতি
এই যুগে মানব সংস্কৃতির যথেষ্ট পরিবর্তন ও অগ্রগতি ঘটে। গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সামাজিক জীবনের অগ্রগতি শুরু হয়।
(৭) পোশাক
এই যুগে বস্ত্রশিল্পের অগ্রগতি ঘটে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র পরিধান করতে শুরু করে।
(৮) নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব
নব্য প্রস্তর যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ব্যাপক অগ্রগতি দেখা যায়, তাকে কেউ কেউ ‘নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার :- নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ আগের তুলনায় আরো বেশি সমাজবদ্ধ হয়। মানুষ একে অপরের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।