উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়: উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সিলেবাস (চতুর্থ অধ্যায়) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে আলিগড় আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল।
আলিগড় আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
প্রশ্ন:- আলিগড় আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। (২০১৭)
উত্তর:- ভূমিকাঃ- ভারতে মুসলমান সমাজে নবজাগরনের উন্মেষে সৈয়দ আহম্মদ খান প্রধানভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজা রামমোহন রায় যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে হিন্দু সমাজে নবজাগরন ঘটিয়েছিলেন, সেই রকম স্যার সৈয়দ আহম্মদ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে মূসলমান সমাজের অনগ্রসরতা দূর করতে সচেষ্ট হন।
আলিগড় আন্দোলনের উৎস
ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগিতা করেছে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে দূরে থেকেছে ফলে সরকারি চাকরী, প্রভাব প্রতিপত্তি সব হারিয়েছে। মুসলমান সমাজের এই হতাশার যুগে আবির্ভূত হন স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান, যিনি মুসলমানদের কাছে পৌছে দেন জাগরনের বানী।
সৈয়দ আহম্মদের লক্ষ্য
দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮১৭ খ্রীঃ সৈয়দ আহম্মদ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য মুসলমানদের ব্রিটিশের প্রতি অনুগত থাকা প্রয়োজন। তাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের সুসম্পর্ক স্থাপন
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার
ভারতীয় মুসলমান সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করার জন্য সৈয়দ আহম্মদ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৬৪ খ্রীঃ উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে তিনি মুসলমান বালকদের জন্য একটি ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৫ খ্রীঃ তিনি আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সেটি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে মুসলমান সমাজের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন করে স্যার সৈয়দ আহম্মদ আলিগড় আন্দোলনের সূচনা করেন।
সামাজিক সংস্কার
সৈয়দ আহম্মদ মুসলমান সম্প্রদায়কে মধ্যযুগীয় আচার ব্যাবহার ও চিন্তা ভাবনা পরিত্যাগ করতে আহ্বান জানান। মুসলমান সমাজে নারীর স্থান উচ্চে আনবার জন্য তিনি পর্দাপ্রথা রহিত করবার নির্দেশ দেন এবং বহুবিবাহ প্রথার নিন্দা করেন। অন্যদিকে মুসলমান নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উপর গুরুত্ব দেন।
আলিগড় আন্দোলন – স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয়। মুসলিম সমাজের এই জাগরণ ‘আলিগড় আন্দোলন’ নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, হিন্দু বিদ্বেষ, বাঙালি বিদ্বেষ, কংগ্রেস বিদ্বেষ এবং ইংরেজ তোষণই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান মূলধন।
আলিগড় আন্দোলনের নীতি
যে চারটি নীতির উপর ভিত্তি করে আলিগড় আন্দোলন গড়ে ওঠে সেগুলি হল —
- (১) ভারতে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী।
- (২) প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ সরকারী পদে নিয়োগ মুসলিম স্বার্থ বিরোধী।
- (৩) ব্রিটিশ সরকারের হাতে মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষিত তাই ব্রিটিশ বিরোধী যে কোনো আন্দোলন থেকে তারা দূরে থাকবে।
- (৪) মুসলমানরা সেইটুকু রাজনীতি করবে যেটুকু হিন্দুদের রাজনৈতিক আন্দোলনের বিরোধিতার জন্য প্রয়োজন।
আলিগড় আন্দোলনের লক্ষ্য
প্রথম জীবনে স্যার সৈয়দ আহম্মদ উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করতেন। তিনি বলতেন হিন্দু মুসলমান একই জননীর দুই সন্তান, ভারত মাতার দুই চক্ষু। কিন্তু পরবর্তীতে থিওডর বেকের প্রভাবে তিনি ক্রমশই সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করতেন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী কোনো রকম রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের যুক্ত না থাকাই উচিত। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়কে কংগ্রেসী আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেন। তিনি কংগ্রেস প্রচলিত আন্দোলনকে “অস্ত্রহীন গৃহযুদ্ধ” বলে চিহ্নিত করেন। সৈয়দ আহম্মদ মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য ১৮৮৮ খ্রীঃ জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প সংস্থা রুপে ‘United Patroitic Assocation’ স্থাপন করেন।
মূল্যায়ণ:- দ্বি-জাতি তত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ প্রচারের জন্য আলিগড় আন্দোলন ও তার প্রবর্তক উভয়েই ঐতিহাসিকদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে যে, সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যও এই আন্দোলন দায়ী ছিল। এসব সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য আলিগড় আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।