২০২৫ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাসের সাজেশন্ ভিত্তিক পিডিএফ নোটস্ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করুণ (দাম প্রতি ক্লাস ৯৯ টাকা)।

👉Chat on WhatsApp

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে জাতিগত প্রশ্ন ও তার প্রভাব

দ্বিতীয় অধ্যায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে জাতিগত প্রশ্ন ও তার প্রভাব আলোচনা কর।

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে জাতিগত প্রশ্ন ও তার প্রভাব

প্রশ্ন:- ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে জাতিগত প্রশ্ন ও তার প্রভাব আলোচনা কর।

ভূমিকা :- আধুনিক ইউরোপে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যাণ্ড, প্রভৃতি উন্নত জাতি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত জাতির উপর নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দেয়। ইউরোপে উন্নত ও সুসভ্য জাতিগুলি অনুন্নত দেশগুলিতে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে শাসক ও শাসিতের জাতিগত পার্থক্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। উন্নত জাতিগুলি তাদের অধীনস্ত উপনিবেশের বাসিন্দাদের হীন বলে মনে করত এবং তাদের উপর শাসন ও শোষণ চালানোর জন্য নিজেদের জাতিগত ঐতিহ্যকে সামনে তুলে আনত। মূলত তারা যে ধরনের বৈষম্যগুলি অনুন্নত জাতির উপর চাপিয়ে দিত সেগুলি হল –

জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার

ইউরোপের ঔপনিবেশিক জাতিগুলি নিজেদের সীমাহীন জাতিগত গৌরব উপনিবেশগুলিতে প্রচার করে। যেমন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস্ মিল মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসনাধীনে অনুন্নত ভারতীয়দের মঙ্গল হচ্ছে, ভারতীয়দের স্বশাসন দানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আবার লর্ড মেকলে বলেন যে, ইউরোপের কোনো গ্রন্থাগারের একটি তাক (Rack) সমগ্র ভারত ও আরবের সাহিত্যের সমকক্ষ।

অভিভাবকত্ব সূচক মানসিকতা

মিশনারী না হয়েও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির কিছু মানুষ এশিয়া ও আফ্রিকা উপনিবেশগুলির বাসিন্দাদের স্বঘোষিত অভিভাবক হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেন, তারা উপনিবেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ডেভিড টমসন বলেছেন যে, এই সব লোকের উদ্যোগ ছাড়া আফ্রিকায় ব্যাপক ও সুনিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব হত না।

জাতির শ্রেষ্ঠত্ব

ব্রিটিশ জীব বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার যোগ্যতমের উদবর্তনের তত্ত্বে বলেছেন প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে শুধুমাত্র যোগ্যতম প্রাণীরাই বিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলি এই তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা প্রচার করে যে, সবচেয়ে যোগ্য বা শক্তিশালী জাতিই জয়ী হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকবে।

শ্রেষ্ঠ জাতির প্রাধান্য

সব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ জাতিকে শ্রেষ্ঠ ও উপনিবেশগুলির বাসিন্দাদের নিকৃষ্ট বলে মনে করত। তারা এই জাতিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঘোষনা করে যে, ‘নিকৃষ্ট জাতির উপর শ্রেষ্ঠ জাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অধিকার জন্মগত।

শেতাঙ্গ উন্নাসিকতা

উপনিবেশিক জাতিগুলি বরাবরই মনে করত কৃষ্ণাঙ্গ জাতির চেয়ে শেতাঙ্গ জাতির মানুষ অনেক বেশি উন্নত সভ্যতার অধীকারী। এশিয়া আফ্রিকার সভ্যতা কখনো শেতাঙ্গদের সমকক্ষ হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে তারা তাদের উন্নত সভ্যতার রূপটি প্রকাশ করত।

জাতিগত ব্যবধান

উপনিবেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসকজাতি এবং উপনিবেশের শাসিত জাতির মধ্যে মর্যাদাগত ব্যবধান খুব সহজেই চোখে পড়ে। উপনিবেশে বসবাসকারী স্থানীয় জনজাতিগুলি বিভিন্ন ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষনের স্বীকার হলেও সেখানে ঔপনিবেশিক জাতির মানুষজন নানা প্রকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা লাভ করেছে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা

ঔপনিবেশিক শাসক জাতি সর্বদাই নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শ্রেষ্ঠ এবং উপনিবেশের সংস্কৃতিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করত। মেকলের কাছে প্রাচ্যের সভ্যতা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতায় পরিপূর্ণ।

বিকৃত জাতীয়তাবাদ

জাতিতত্ত্বের ধারণায় বিকৃত জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে মারাত্মক। উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুতে সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা তাদের বিকৃত উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করতে থাকে। আসলে বিকৃত জাতীয়তাবাদ প্রচারের মূল কথা হল শোষিত জাতিগুলির ওপর শোষণ, নির্যাতন, দমন-পীড়ন বজায় রাখা।

সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ

ইউরোপরে ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিরা নিজেদের লক্ষ্য ও স্বার্থকে জাতীয় লক্ষ্য ও স্বার্থের সমার্থক বলে প্রচার করতে থাকে। এই ধরনের জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত।

প্রভাব

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির সাধারণ মানুষ সংকীর্ণ আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে সমর্থন করে। ফলে সংগত কারণেই এই জাতিগত ব্যবধানের সদর্থক ও নঞর্থক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

নঞর্থক প্রভাব

ঔপনিবেশিক শাসনে জাতিগত প্রশ্নের নঞর্থক প্রভাব গুলি হল –

(ক) অমানবিকতা

জাতিগত ধারণার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব হল ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা এশিয়া, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগুলি দীর্ঘকাল ধরে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবহেলা ও অমানবিকতার স্বীকার হয়। শাসিত জাতিগুলি নিজেরাই নিজেদের দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়।

(খ) জাতিগত শোষণ

জতিতত্ত্বের ধারণাকে সামনে রেখে ঔপনিবেশিক শাসকরা উপনিবেশের উপর সামাজিক অর্থনৈতিক শাসন ও শোষণ চালিয়েছিল। জাতিগুলির উপর বিপুল পরিমাণ করের বোঝা চাপানো, উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ, শিল্পের ধ্বংস সাধন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে উপনিবেশের জাতিগুলিকে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে।

(গ) দেশীয় ঐতিহ্যে আঘাত

শেতাঙ্গ জাতি নিজেদের ঐতিহ্যে গর্বিত হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলির বিভিন্ন জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যে আঘাত করে। ফলে প্রাচ্যের বহু প্রাচীন সংস্কৃতি লুপ্ত হতে থাকে।

(ঘ) শ্রমিক রপ্তানি

পশ্চিমের শেতাঙ্গ জাতিগুলি প্রথম দিকে কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশে রপ্তানি করে সেখানকার উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখত। আফ্রিকার মরিশাস, ত্রিনিদাদ, জামাইকা, নাটাল এবং এশিয়ার ভারত, চিন প্রভৃতি দেশের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা আজও ইউরোপের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে।

(ঙ) বৈষম্য

উপনিবেশে শাসক শেতাঙ্গ ও শাসিত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তীব্র বৈষম্য বজায় ছিল। যেমন বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ বিচারক, শেতাঙ্গ অভিযুক্তদের বিচার করতে পারত না। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গদের যোগ্যতা থাকলেও উপযুক্ত মর্যাদা ও বেতন তারা পেত না। এই বৈষম্য শাসক ও শাসিতের সামাজিক সম্পর্ককে ব্যাহত করেছিল।

সদর্থক প্রভাব

জাতিগত ধারণার সবই যে নেতিবাচক দিক ছিল তা নয়, কিছু কিছু ইতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়। যেমন –

(ক) পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সান্নিধ্য

ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসারের ফলে প্রাচ্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়। ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিরা উপনিবেশগুলিতে অনগ্রসর মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে ও সামাজিক কাজকর্ম চালিয়ে সেখানকার সংস্কৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলেন।

(খ) জ্ঞানচর্চার প্রসার

ঔপনিবেশিক জাতিগুলি তাদের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানভাণ্ডার এশিয়া ও আফ্রিকার অনগ্রসর জাতিগুলির মধ্যে সঞ্চালিত করে। ফলে উপনিবেশের শাসিত মানুষরাও তাদের সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে।

(গ) শিল্পকলার অগ্রগতি

পাশ্চাত্যের স্থাপত্য ভাষ্কর্য ও চিত্র শিল্পীরা উপনিবেশের সংস্পর্শে এসে তাদের শিল্প সৃষ্টিতে নতুনত্ব এনেছিল। স্পেনের পাবলো পিকাশো আফ্রিকার চিত্রকলা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার বিখ্যাত চিত্রগুলি এঁকেছিলেন।

(ঘ) গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার

ইউরোপীয় সভ্য জাতিগুলি উপনিবেশে শোষণ ও অত্যাচার চালিয়েছিল একথা যেমন ঠিক তেমনি নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এশিয়া আফ্রিকার মানুষদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, মানবিকতা, গণতন্ত্র প্রভৃতি সুমহান আদর্শে উদ্ভাসিত করেছিল।

(ঙ) সঙ্গীতে অগ্রগতি

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীত চর্চার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী ক্লদ দুবুসি প্রাচ্যের সঙ্গীতের এতটাই অনুরাগী হয়ে পড়েন যে, প্রাচ্যের সুরের প্রভাবে তিনি বহু পাশ্চাত্য সঙ্গীতে সুরারোপ করেন।

(চ) নবজাগরণের সূচনা

জাতিগত ধারণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল পাশ্চাত্য শক্তির সংস্পর্শে এসে প্রাচ্য দেশগুলিতে নবজাগরণের সূচনা হওয়া। যদিও অনেকে এই ধরনের নবজাগরণকে ‘Colonial Modernisation’ বলে অভিহিত করেছেন।

উপসংহার :- এইভাবে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসারের ফলে ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপনিবেশের শাসিত জাতিগুলি সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এর অনিবার্য ফল উপনিবেশিকতার অবসান।

Leave a Comment