উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সম্পর্ক

দ্বিতীয় অধ্যায়: উপনিবেশবাদ কী? উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সম্পর্ক

ভূমিকা :- লাতিন শব্দ ‘Colonia’ থেকে ইংরেজি ‘Colony’ শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ উপনিবেশ। আর উপনিবেশবাদ শব্দটি এসেছে Colonialism থেকে। উপনিবেশ শব্দটির মূল অর্থ হল মানব সমাজের একটি স্থানান্তরিত অংশ।

উপনিবেশবাদ

উপনিবেশবাদ বলতে বোঝানো হয় কোন ভূখণ্ড বা অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণকারী কোন সার্বভৌম শক্তির কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা।

সাম্রাজ্যবাদ

লাতিন শব্দ ইম্পেরিয়াম থেকে ইংরেজি Imperialism শব্দটি এসেছে, যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো সাম্রাজ্যবাদ। প্রাথমিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের অর্থ ছিল সামরিক কর্তৃত্ব কিন্তু পরবর্তীকালে এর অর্থ হয়ে দাঁড়ায় বৃহৎ বা শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সাম্রাজ্যবাদ হল এমন একটি নীতি, প্রক্রিয়া বা কার্যধারা যার দ্বারা শক্তিশালী রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে আর অধিকৃত রাষ্ট্র বা তার অধিবাসীগণ পূর্বোক্ত রাষ্ট্রের আধিপত্য স্বীকার করে।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের দুটি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারণা। এই দুই রকম ধারণার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় হলেও উভয়ের মধ্যে বেশকিছু মিল ও অমিল দেখতে পাওয়া যায়।

মিল

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নির্ণয় করার ক্ষেত্রে দুই ধারণার মধ্যে যে মিল আছে তা নিম্নরূপ –

প্রথমত :- উপনিবেশবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো শক্তিশালী রাষ্ট্রকর্তৃক অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। অতএব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করাই হল উভয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত :- উপনিবেশবাদ হল সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নের একটি মাধ্যম মাত্র। কারণ, শক্তিশালী কোনো দেশ যে সমস্ত উপায়ে সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে উপনিবেশবাদ হল সেই সমস্ত উপায়ের অন্যতম অংশ।

তৃতীয়ত :- উপনিবেশবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য হল অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন চালানো। উপনিবেশবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদ অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রকে শোষণ করে নিজ রাষ্ট্রের সার্বিক বৃদ্ধি ঘটায়।

অমিল

উপরিউক্ত মিলগুলি থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বেশ কিছু অমিল পরিলক্ষিত হয়। যেমন –

প্রথমত :- উপনিবেশবাদ হল কোনো দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর শক্তিশালী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ হল কোন দুর্বল রাষ্ট্র বা দুর্বল জাতির ওপর শক্তিশালী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

দ্বিতীয়ত :- প্রাচীনত্বের বিচারে উপনিবেশবাদ হল অনেক নবীন। পঞ্চদশ শতকে উপনিবেশবাদের প্রসার শুরু হয়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ধারণাটি অনেক প্রবীণ। বলা যায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের যুগেও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অস্তিত্ব ছিল।

তৃতীয়ত :- উপনিবেশবাদের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে নিজ দেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে উপনিবেশ থেকে সম্পদ আহরণ করা। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডকে দখল করে নিজের সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো বা নিজ রাষ্ট্রের সীমানার ব্যাপ্তি ঘটানো।

চতুর্থত :- ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি পঞ্চদশ শতকের পর থেকে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। তারা অবশ্যই নৌ-শক্তিতে বলিয়ান হয়ে এই উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সুপ্রাচীনকাল থেকেই শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি চরিতার্থ করেছে এবং তারা তাদের পদক্ষেপ হিসেবে অন্য দেশের ভূখণ্ড দখল করে নিজের দেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করেছে।

পঞ্চমত :- আধিপত্যের দিক থেকে উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক দেশের জনগণ উপনিবেশে এসে বসবাস শুরু করে কিন্তু তাদের আনুগত্য থাকে মাতৃভূমির উপর। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের জনগণ অধিকৃত ভূখণ্ডে বসবাস নাও করতে পারে এবং অধিকৃত ভূখণ্ডের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেখানে তারা সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

ষষ্ঠত :- আধিপত্যের কৌশল হিসেবে যদি দেখা যায় তাহলে ঔপনিবেশিকতাবাদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক দেশের জনগনের একটা বড় অংশ উপনিবেশে বসবাস করতে করতে সেখানকার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে হস্তগত করে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বিজিত ভূখণ্ডের উপর সাধারণত রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

সপ্তমত :- উপনিবেশবাদের উদাহরণ হিসেবে আমরা কতগুলি ইউরোপের শক্তির কথা বলতে পারি। যেমন – ইংল্যান্ড ভারত, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশে উপনিবেশবাদের প্রসার ঘটিয়েছে। অন্যদিকে উনিশ শতকের শেষদিকে আফ্রিকাকে নিয়ে যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছিল তা সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত নিদর্শন।

উপসংহার :- সাম্রাজ্যের স্বার্থেই উপনিবেশের সম্পদ ও শক্তি নিয়োজিত হয়। তাই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ হলো অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত দুটি ব্যবস্থা। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও কার্যক্ষেত্রে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই মনে করা হয় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ একে অন্যের পরিপূরক।

Leave a Comment