উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায়: অতীত স্মরণ হতে স্মৃতিকথা বলতে কীবোঝ ? স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য লেখ। স্মৃতিকথার কয়েকটি উদাহরণ দাও। ভারতের ইতিহাস রচনায় এর গুরুত্ব বর্ননা করা হল।
স্মৃতিকথা বলতে কী বোঝ? স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য? স্মৃতিকথার উদাহরণ? ভারতের ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব
প্রশ্ন:- স্মৃতিকথা বলতে কীবোঝ? স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য লেখ। স্মৃতিকথার কয়েকটি উদাহরণ দাও। ভারতের ইতিহাস রচনায় এর গুরুত্ব বর্ননা কর। (২০১৮)
ভূমিকা :- অতীতের ঘটনায় অংশগ্রহণকারী বা ঘটনার সাক্ষী কোনো ব্যক্তি তাঁর অতীত স্মৃতি থেকে সেই সময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে থাকেন। আর এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম মৌখিক উপাদান স্মৃতিকথা।
স্মৃতিকথা
স্মৃতি বলতে মনে রাখা বিষয়কে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে নিকট অতীতকে স্মরণ করা যায়। কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁর জীবনের ফেলে আসা সময়ের কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ বা প্রকাশ করে অতীতকে স্মরণ করে। এইভাবে অতীত স্মরণকেই বলা হয় স্মৃতিকথা।
অন্যভাবে বলা যায়, স্মৃতিকথা হল এক ধরণের সাহিত্য, যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে তুলে ধরেন।
স্মৃতিকথার উদাহরণ
জ্যোতি বসুর লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্ৰন্থ “যতদূর মনে পড়ে” ইংরেজ শাসন ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাস জানতে সাহায্য করে।
স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য
স্মৃতিকথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তবে স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
(i) প্রকৃত ঘটনা
লেখক সাধারণত প্রকৃত ঘটনাই তাঁর স্মৃতিকথায় তুলে ধরেন বলে মনে করা হয়।
(ii) বাস্তব ভিত্তি
স্মৃতিকথা কোন কাল্পনিক উপন্যাস নয়। এর একটি বাস্তব ভিত্তি আছে।
(iii) বিশেষ ঘটনার উপস্থাপন
স্মৃতিকথায় লেখকের সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোচনা থাকে না। থাকে জীবনকালে ঘটে যাওয়া সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার বিবরণ। যেমন, হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের “উদবাস্তু” গ্ৰন্থে কেবল পশ্চিমবঙ্গের উদবাস্তুদের জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে।
(iv) উত্তম পুরুষে লেখা
লেখক নিজে কাহিনির কথক হিসাবে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাই রচনার উপস্থাপনা করা হয় উত্তম পুরুষে।
(v) নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ
স্মৃতিকথায় লেখকের কোন ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশিত হয়। যেমন, দক্ষিণারঞ্জন বসুর “ছেড়ে আসা গ্রাম” গ্রন্থে দেশভাগের যন্ত্রণার বিশেষ অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে।
স্মৃতিকথার উদাহরণ
লেখক | স্মৃতিকথা | বিষয়বস্তু |
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | জীবনস্মৃতি | ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ, স্বদেশ ভাবনা |
মান্না দে | জীবনের জলসাঘরে | মুম্বাই ও কলকাতার সংগীত জীবন |
সুফিয়া কামাল | একাত্তরের ডাইরি | বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনির বর্বরতা |
নারায়ণ সান্যাল | আমি নেতাজিকে দেখেছি | সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবন |
স্মৃতিকথার গুরুত্ব
ভারতের ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য –
(i) গুণিজনদের লেখা তথ্য
স্মৃতিকথাগুলি বেশিরভাগই গুণীজনদের লেখা। তাই তাতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
(ii) বাস্তবতা
স্মৃতিকথাগুলি কাল্পনিক বিষয় নয়। তাই এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়।
(iii) প্রত্যক্ষ সাক্ষী
বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ঘটনার বিবরণ দিয়ে থাকেন। তাই উক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।
(iv) স্থানীয় ইতিহাসের উপাদান
স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। স্থানীয় ইতিহাস লেখায় এটি বিশেষ উপযোগী।
(v) ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব
বিভিন্ন স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল স্মৃতিকথাগুলি।
সমালোচনা বা মূল্যায়ন :- কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক উপাদান স্মৃতিকথা থেকে পাওয়া যায় না। কারণ, কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানাতে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা অতিরঞ্জিত হয়ে যায়। স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তি অনেক সময় সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারেন না। একই ঘটনা বহুকাল পরে বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। ফলে সঠিক ঘটনা জানা মুশকিল হয়ে পড়ে। সুতরাং বলা যায়, যেখানে লিখিত ইতিহাস পৌছাতে পারে না, সেখানেই স্মৃতিকথার প্রয়োজন হয়। স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।