১৯০৯ সালের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনের শর্ত, ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা

উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায় – ঔপনিবেশিক ভারতের শাসন হতে ১৯০৯ সালের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনের শর্ত, ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা করা হল।

Table of Contents

১৯০৯ সালের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনের শর্ত, ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা

প্রশ্ন:- ১৯০৯ সালের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনের শর্ত, ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তর:-

মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন

ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে খুশি করে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালে ভারত সচিব জন মর্লে ও বড়োলাট লর্ড মিন্টো একটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন। এই শাসনসংস্কার মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন বা ১৯০৯ সালের কাউন্সিল আইন নামে পরিচিত।

পটভূমি বা কারণ

এই আইন প্রবর্তনের পিছনে নিম্নলিখিত কারণগুলি সক্রিয় ছিল-

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ

১৮৫৮, ১৮৬১, ১৮৯২ সালের ভারত শাসন আইন ছিল একধরণের ‘ধাপ্পাবাজি’ (বিপান চন্দ্র)। তাই জাতীয় কংগ্রেস আইন পরিষদে নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য বাড়ানো ও তাদের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়।

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সরকারকে বিপাকে ফেলে দেয়।

মুসলিম লিগের দাবি

১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলিম লিগের সদস্যরা তাদের সদস্যদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানালে সরকার সংকটে পড়ে।

বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্ভব

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের একটি ধারা ক্রমে বিপ্লবী আন্দোলনে পরিণত হলে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে খুশি করে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়।

আইনের শর্ত বা বৈশিষ্ট্য

মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের শর্তগুলি বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ঠ্য চোখে পড়ে –

কার্যনির্বাহী পরিষদের ক্ষেত্রে

(১) ভারতীয় প্রতিনিধি নিয়োগ

বড়োলাটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদে এবং প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।

(২) সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি

বাংলা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশের গভর্নরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২ থেকে ৪ জন করার সিদ্ধান্ত হয়।

আইন পরিষদের ক্ষেত্রে

(১) কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি

কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬০ জন করা হয়। এদের মধ্যে ২৮ জন সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতেন। ২৭ জন সদস্য প্রাদেশিক আইনসভাগুলির দ্বারা নির্বাচিত হতেন। এবং বাকি ৫ জন ভাইসরয় বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করতেন।

(২) বাজেট পরিকল্পনা

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ্গুলি বাজেট তৈরি, বাজেট পাস, বাজেট সম্পর্কে আলোচনা ও ভোটদানের অধিকার পায়।

(৩) সুপারিশ করার ক্ষমতা

আইন পরিষদ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায়।

(৪) মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন

মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।

(৫) প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি

প্রদেশিক আইন পরিষদগুলির সদস্যসংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যে রাখার ও নির্বাচিতদের তুলনায় মনোনীতদের সংখ্যা বেশি রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

(৬) সদস্যদের অপসারণ

গভর্নর-জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাদের অপছন্দের যে-কোন সদস্যকে আইন পরিষদ থেকে অপসারণের অধিকার পান।

মূল্যায়ন ( সমালোচনা)

মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট ভারতবাসির আশা পুরণ করতে পারেনি। কারণ এই আইন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। যেমন-

(১) আইন সভার অনধিকার

দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বৈদেশিক নীতি ইত্যাদি বিষয়ে কোন প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভাকে দেয় নি।

(২) দায়িত্বশীল শাসনের অভাব

ভারতবর্ষে কোন দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেনি।

(৩) ক্ষমতাহীন জনপ্রতিনিধি

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়নি।

(৪) বড়োলাটের আধিপত্য

প্রকৃতপক্ষ্যে বড়োলাটের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেয়।

(৫) কংগ্রেসের অসন্তোষ

কংগ্রেসের নরমপন্থী কিম্বা চরমপন্থি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

(৬) সাম্প্রদায়িক নীতি

পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে, এই আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহিত করেছিল। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র লিখেছেন, “মুসলিম স্বাতন্ত্রের দাবীকে প্রশ্রয় দিয়ে ব্রিটিশ সরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কঠিন পথকে আরও কঠিন করে তোলে।

গুরুত্ব বা তাৎপর্য

বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এই আইনের গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। কারণ, ভারতের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির ওপর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল। যেমন-

  • (১) এই আইন ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাতে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়।
  • (২) বড়োলাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে প্রথম ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়।
  • (৩) ভারতে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
  • (৪) সর্বোপরি, এই আইন ভারতে সাংবিধানিক রীতিনীতির প্রচলন ও আইনের শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।

Leave a Comment