উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় ‘রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও তার শাসন যন্ত্র’ থেকে জিয়াউদ্দিন বরনি বর্ণিত সুলতানি যুগের নরপতিত্বের আদর্শ কী ছিল? দিল্লি সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল আলোচনা কর।
সুলতানি আমলের ইক্তা প্রথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
প্রশ্ন:- সুলতানি আমলের ইক্তা প্রথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
ভূমিকা:- দিল্লির সুলতানি শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তাদারদের দ্বারা পরিচালিত ইক্তা প্রথা। ইক্তা গ্রহণকারীরা মাকতি বা ইক্তাদার নামে পরিচিত ছিল।
অর্থ
‘ইক্তা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল একটি অংশ বা এলাকা। রাজস্ব ব্যবস্থার বিচারে ইক্তা শব্দের সহজ অর্থ হল ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্যের ওপর বিশেষ কোনাে ব্যক্তিবর্গকে সরকার কর্তৃক অধিকারদান।
প্রবর্তন
ইক্তা ব্যবস্থা ইসলামীয় জগতে প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে তুর্কিরা এই ব্যবস্থা ভারতে আমদানি করে। ভারতে ত্রয়ােদশ শতকের সূচনা পর্বে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ইক্তা প্রথার প্রবর্তন করেন।
ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইক্তাদার তাঁর প্রাপ্ত ইক্তা থেকে রাজস্ব আদায় ও ভােগ দখলের বিনিময়ে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকতেন। যেমন —
- (১) সুলতানের প্রয়ােজনের সময় ইক্তাদার সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতেন।
- (২) নির্দিষ্ট ইক্তা এলাকায় ইক্তাদারকে আইন-শৃঙ্খলা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হত।
- (৩) ইক্তাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্য রাজস্ব বা কর ইক্তাদারদের আদায় করতে হত।আদায়কৃত রাজস্ব থেকে নিজ ব্যয় বাবদ অর্থ বাদ দিয়ে উদবৃত্ত অর্থ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিতে হত।
উদ্দেশ্য
ভারতে ইক্তা প্রথা প্রবর্তন করার পশ্চাতে সুলতানদের বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। যেমন –
- (১) ভারতে প্রচলিত সামন্তব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।
- (২) ভারতে সুলতানি অধিকৃত এলাকাগুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকরী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা।
- (৩) আমির-ওমরাহদের সন্তুষ্ট করে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা দূরীভূত করা।
- (৪) রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
- (৫) নব বিজিত অঞ্চলগুলির রাজস্ব আদায়ের অনিশ্চয়তা দূরীভূতকরা।
ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ইক্তা ব্যবস্থা ছিল সুলতানি যুগের একটি আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
(১) রাজস্ব আদায়
ইক্তাদার তাঁর নির্দিষ্ট ইক্তার কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করলেও কৃষক সমাজ বা জমির ওপর তাঁর কোন ধরনের অধিকার ছিল না। কারণ, জমি ও কৃষক সমাজ ছিল সুলতানের সম্পত্তি।
(২) কৃষকের অধিকার
রাজস্বের পরিমাণইক্তাদার বা মাকতি নিজে নির্ধারণ করতে পারতেন না। প্রজা বা কৃষক ইচ্ছা করলে রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থা বা সমস্যার কথা জানাতে পারত।
(৩) ইক্তাদারের দায়িত্ব
ইক্তার আদায়কৃত রাজস্ব থেকে ইক্তাদারকে নির্দিষ্ট সৈন্যবাহিনী রাখতে হত। প্রয়ােজনের সময় সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতে হত।
(৪) শাস্তি
ইক্তার আইন-কানুন লংঘন করলে সুলতান ইক্তাদার বা মাকতিকে কঠোর শাস্তি দিতেন। এমনকি তাঁর ইক্তা বাজেয়াপ্তও করতেন l
(৫) সুলতানের ওপর নির্ভরতা
ইক্তাদারের নিয়ােগ, স্থায়িত্ব, বদলি ও পদচ্যুতি সুলতানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল।সুলতান বিরাগভাজন হলে ইক্তাদারকে পদচ্যুত হতে হত।
(৬) বদলি
মাঝে মধ্যেই ইক্তাদারদের এক ইক্তা থেকে অন্য ইক্তায় বদলি করা হত।
ইক্তা প্রথার সংস্কার ও বিবর্তন
সুলতান ইত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ থেকে বিভিন্ন সময়ে এই প্রথার সংস্কার ও বিবর্তন ঘটে। যেমন –
(১) ইলতুৎমিসের আমল
ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের পর সুলতান ইলতুৎমিস তাকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন। কোনাে ইক্তার ওপর বংশানুক্রমিক অধিকার যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য তিনি ইক্তাদারদের বদলির নীতি নেন।
(২) বলবনের আমল
বলবনের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়। যে সমস্ত ইক্তাদার ভাতা ও জমি ভােগদখল করলেও প্রয়ােজনের সময় সামরিক সাহায্য দিতেন না, বলবন তাদের তালিকা তৈরি করান। ইক্তাদাররা যাতে সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে, তার জন্য বলবন প্রতিটি ইক্তায় খােয়াজা নামে এক ধরনের হিসাবপরীক্ষক নিয়ােগ করেন।
(৩) আলাউদ্দিন খলজির আমল
আলাউদ্দিন খলজির আমলে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে ইক্তা ব্যবস্থাতে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। তিনি দিল্লি থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে ইক্তা ব্যবস্থা বজায় রাখেন এবং নিকটবর্তী অঞ্চল গুলির জমি খালিসা জমিতে পরিণত করেন। তিনি সেনাদের ইক্তাদানের পরিবর্তে নগদ বেবতনদানের প্রথা চালু করেন।
(৪) মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। তিনি সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানেইচ্ছুক ব্যক্তিকে ইক্তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। তিনি সেনাদের নগদ বেতন দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন।
(৫) ফিরােজশাহ তুঘলকের আমল
ফিরােজশাহ তুঘলক ব্যাপকভাবে ইক্তা বিতরণ করলে খালিসা জমির পরিমাণ কমে। তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে বংশানুক্রমিক করে দেন।
ত্রুটি
ইক্তা ব্যবস্থায় বেশ কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) দুর্নীতি
ডক্টর এ এল শ্রীবাস্তব মতে ইক্তাদাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরায়ন হতেন। ভুল হিসেব দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিজেরাই আত্মসাৎ করতেন।
(২) সামন্ততন্ত্রের কুফল
সামন্ততন্ত্রের কুফল গুলি দূর করার জন্য ইক্তা প্রথার প্রচলন করা হলেও এই প্রথার মধ্যেই সামন্ততন্ত্রের ত্রুটি বিচ্যুতি গুলি ধরা পড়ে।
(৩) রাজস্ব আদাই হ্রাস
বেশিরভাগ খালিসা জমিতে ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে সরকারি রাজস্বেরপরিমাণ অনেক কমে যায়।
(৪) বংশানুক্রমিক হওয়ার কুফল
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা বংশানুক্রমিক হলে ইক্তাদারদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
গুরুত্ব
বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্বেও সুলতানি যুগে ভারতে ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –
(১) সাম্রাজ্যের প্রসার
ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা ভারতে নতুন নতুন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ফলে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে।
(২) দূরবর্তী স্থানের সঙ্গে যােগাযােগ
ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজধানী দিল্লি থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যের দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।
(৩) অভিজাতদের সন্তুষ্টি
বিভিন্ন অভিজাত ও আমির-ওমরাহদের ইক্তা প্রদান করে দিল্লির সুলতানরা তাঁদের অসন্তোষ দূর করতে সক্ষম হন।
(৪) প্রশাসনের উৎকর্ষতা
ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা প্রশাসনের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে শাসন ব্যবস্থায় উৎকর্ষতা আনেন।
(৫) রাজকোশের সমৃদ্ধি
ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব রাজকোশে জমা পড়ে এবং সুলতানের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার :- সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনের মূল ভিত্তি ছিল ইক্তা ব্যবস্থা।সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় সুলতানি সাম্রাজ্যের ভালাে-মন্দেরদায় দায়িত্ব এই ইক্তাদারদের ওপরই নির্ভর করে।