উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় ‘রাজনৈতিক বিবর্তন: শাসনকার্য ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা’ থেকে জিয়াউদ্দিন বরনি বর্ণিত সুলতানি যুগের নরপতিত্বের আদর্শ কী ছিল? দিল্লি সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল আলোচনা কর।
সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা
প্রশ্ন:- সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
ভূমিকা:- ইংরেজি’Empire’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল সাম্রাজ্য। ইংরেজি ’empire’ শব্দটি লাতিন শব্দ imperium থেকে এসেছে, যার অর্থ হল শক্তি (Power) বা কর্তৃত্ব (authority)।
সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা
সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে নানা দৃষ্টিভঙ্গী পাওয়া যায়। যেমন –
- (১) সাধারণভাবে সাম্রাজ্য বলতে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের অন্তর্গত একজন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর অধীনস্ত এমন বিস্তৃত ভূখণ্ড বা বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রকে বোঝায়, যা রাজ্যের চেয়ে সুবিস্তৃত হবে। যেখানে সর্বদা বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস থাকবে এবং সেই সব জাতি ও সম্প্রদায়ের শাসন করার উদ্দেশ্যে সম্রাটের একটি সুনির্দিষ্ট শাসন কাঠামো থাকবে।
- (২) সাম্রাজ্য হল কোনো শাসকের নেতৃত্বাধীন সেই ভৌগোলিক অঞ্চল যে অঞ্চল সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সীমানার প্রসার ঘটায়।
- (৩) সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ‘The Oxford English Reference Dictionary’-তে শাসক ও শাসিতের ব্যবধানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘সাম্রাজ্য হল রাজনৈতিক ও সামরিক ভিত্তিতে গঠিত ভূখণ্ডে সেই জনসমষ্টি যারা সংস্কৃতিগতভাবে এবং জাতিগতভাবে শাসক গোষ্ঠীর থেকে পৃথক”।
সাম্রাজ্যের বৈশিষ্ট্য
প্রাচীনকালে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ
সাম্রাজ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করা। সাম্রাজ্যের উত্থান এবং প্রসারে সাম্রাজ্যবাদই ছিল ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নীতি। মূলত সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেই ইতিহাসের সুবৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উৎপত্তি ও প্রসার ঘটেছিল।
(২) বৃহদায়তন
সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর বিশালআয়তন। পূর্বেকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করার ফলে বহু রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটে। এই অবলুপ্ত রাষ্ট্রগুলির ভূখণ্ড দখল করে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পায়।
(৩) চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী প্রধান শাসক
সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক বা সম্রাট রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কখনো কখনো নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করে সাধারণ প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। রাষ্ট্র শাসনে জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য থাকে না। স্বাভাবিক কারণেই সাম্রাজ্যের জনগণের প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ করার অধিকার সম্রাট স্বীকার করেন না।
(৪) রাজ্য জোট
সাম্রাজ্য হল কোনো একটি কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ কতগুলি রাজ্যের একটি জোট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে ৫টি রাজ্য বা প্রদেশের সমন্বয়ে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই পাঁচটি প্রদেশের নাম ছিল উত্তরাপথ, অবন্তী, দক্ষিণাপথ, প্রাচ্য ও কলিঙ্গ।
(৫) রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের উপস্থিতি
সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হয় কোনো রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের দ্বারা। রাজতন্ত্র সাধারণত বংশানুক্রমিক হয়। অর্থাৎ রাজা বা সম্রাটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী সিংহাসন লাভ করেন।
(৬) বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব
সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জাতির বসবাস লক্ষ্য করা যায়। এর অধিকাংশই সম্রাট অর্থাৎ শাসকের জাতি থেকে আলাদা হয়। কিন্তু বিভিন্ন জাতির বসবাসের কারণে সাম্রাজ্যকে কখনোই আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে এক করে দেখা ঠিক নয়।
(৭) উপাদানের বিভিন্নতা
সাম্রাজ্য বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এই উপাদানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি। সাম্রাজ্যের এই উপাদানগুলিতে বিভিন্নতা বা প্রভেদও থাকে।
উপসংহার :- প্রাচীন যুগ থেকে দেখা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন জনপদ, মহাজনপদ বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করে যুগে যুগে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির উত্থান ঘটেছিল। আবার সাম্রাজ্যবাদী সেই সব রাষ্ট্রের আয়তন বাড়তে বাড়তে ইতিহাসের নিয়মেই তার পতনের পথও প্রস্তুত হয়েছিল।