উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়- ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃতি হতে ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি কি ছিল ও এই বাণিজ্যের অবসান হয় কেন তা আলোচনা করা হল।
ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য
প্রশ্ন:- ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি কি ছিল? এই বাণিজ্যের অবসান হয় কেন?
ভূমিকা :- চীন -এর দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর তাং যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর আধুনিক যুগেও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিশেষ পরিচিত।
ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা
১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে চীনা আদালত এক নির্দেশনামার দ্বারা শুধু মাত্র ক্যান্টন বন্দরকে বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করে। এরপর ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চীনে বিদেশিদের এক-বন্দরকেন্দ্রিক যে বাণিজ্য প্রথার সূচনা হয় তা ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা নামে পরিচিত। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানকিং – এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রথার অস্তিত্ব ছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
ক্যান্টন বাণিজ্য ব্যবস্থায় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। এর মধ্যে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
কো-হং বাণিজ্য
ক্যান্টন বন্দরে বিদেশি বণিকরা চীনা বণিক গোষ্ঠী কো-হং – এর মাধ্যমে বাণিজ্য করত। বাণিজ্যের সমস্ত রীতি নীতি ঠিক করত এই বণিক গোষ্ঠী। তাদের নির্ধারিত মূল্যে বিদেশি বণিকরা পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয় করতে বাধ্য হত।
ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক বাণিজ্য
কো-হং নামে বণিকসঙ্ঘ দ্বারা পরিচালিত ক্যান্টনের বাণিজ্য ছিল মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক। ফলে চীনের সাথে বিদেশি বণিকদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন হত না।
একতরফা বাণিজ্য
ক্যান্টনে বিদেশি বণিকরা কেবল চীনা পণ্য (যেমন – চা, চিনি, কাগজ, চিনামাটির পাত্র ইত্যাদি) কিনতে পারত। তারা কোনো পণ্য চীনে বিক্রি করতে পারত না। অর্থাৎ এই বাণিজ্য ছিল একতরফা।
কাওতাও প্রথা
চীনা সম্রাটের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে বিদেশি বণিকদের কাওতাও প্রথা মেনে চলা আবশ্যক ছিল। এই প্রথা অনুসারে যে কোনো বিদেশিকে চীনের সম্রাটের সামনে ভূমি পর্যন্ত নত হতে হতো।
নজরানা পদ্ধতি
বিদেশি বণিকদের চীনে ব্যবসা করতে হলে সেখানকার সম্রাটকে উপঢৌকন বা ভেট দিতে বাধ্য হত। এই প্রথা নজরানা পদ্ধতি নামে পরিচিত।
রুদ্ধদ্বার নীতি
ক্যান্টন বাণিজ্যে যুক্ত বিদেশি বণিকদের চীনা ভাষা ও আদবকায়দা শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। বিদেশি বাণিজ্য কুঠিতে মহিলা ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ, দাসী নিয়োগ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। বাণিজ্যের মরসুম শেষ হলে বিদেশি বণিকরা ক্যান্টন ত্যাগ করতে বাধ্য থাকত। বিদেশি বণিকদের প্রতি চীনের এই কঠোর নীতি রুদ্ধদ্বার নীতি নামে পরিচিত।
মূল শহরে প্রবেশে বাধা
ক্যান্টন বাণিজ্যে যুক্ত বিদেশিরা শহরের মূল ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালাতে বাধ্য ছিল। প্রধান ফটক পেরিয়ে কখনোই তারা মূল শহরে প্রবেশ করতে পারত না।
ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান
ক্যান্টন বাণিজ্যের নানা ধরনের কঠোর শর্ত ও বিধিনিষেধের নীতি বিদেশি বণিকদের ব্যবসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। ফলস্বরূপ এই বাণিজ্য প্রথার অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ হল –
অপমানজনক প্রথা
ক্যান্টন বাণিজ্য লাভজনক হলেও বিদেশিদের কাছে তা অপমানজনক ছিল। বিভিন্ন বিধিনিষেধ, চীনা আইনের বিচার তাদের অসহ্য করে তোলে।
বিরূপ মানসিকতা
চীনাদের কাছে বিদেশি পণ্যের প্রয়োজন ছিল না, অথচ চীনের মহামূল্যবান চা বিদেশি বণিকদের বিক্রি করতে হত। চীনারা মনে করত বিদেশি বণিকরা চীনে বাণিজ্য করতে বেশি আগ্রহী।
ব্যবসা বন্ধের হুমকি
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলি চীনের সাথে সমমর্যাদায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু চীন বিদেশিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিত।
ইংল্যান্ডের দৌত্য
মর্যাদা সম্পন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার চীনে বেশ কয়েকটি দূত প্রেরণ করে। কিন্তু চীন কোনো আগ্ৰহ না দেখালে ইংরেজরা বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে।
বিকল্প ভাবনা
এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার বিকল্প কিছু ভাবতে শুরু করে। তারা যুদ্ধের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে উদ্যোগী হয়।
আফিম ব্যবসা
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ বণিকরা চোরা পথে ভারত থেকে চীনে আফিম রপ্তানি করতে শুরু করলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চীন-ব্রিটেন যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) চীনের পরাজয় ঘটলে ক্যান্টন বাণিজ্য ভেঙে পড়ে।
উপসংহার :- ইংরেজ বণিকদের কাছে লাভজনক থাকায় তারা ক্যান্টন বাণিজ্য ছাড়তে চায় নি। তাই তারা চীনা দমনমূলক আইন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিকল্প পথ হিসেবে যুদ্ধকেই বেছে নেয়। ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের পর বিদেশি বণিকরা চীনকে তরমুজের মতো খন্ডীকরণ করে নেয়।