সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা

সপ্তম অধ্যায়: সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর।

Table of Contents

সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা

১. সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর। (২০১৫, ২০১৮)

ভূমিকা :- মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়।

সুয়েজ সংকট

ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের মেয়াদে খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘােষণার মাধ্যমে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। ফলে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে এক সমস্যা তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বলা হয়।

সুয়েজ সংকটের কারণ

ঐতিহাসিক সুয়েজ সংকটের প্রধান কারণগুলি হল –

(১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব

আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুদ্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনােমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখনও ব্রিটেন ও ফ্রান্স সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এর ফলে সুয়েজ সংকট তৈরি হয়।

(২) আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প

নাসের চেয়েছিলেন মিশরের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নীলনদের ওপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ করতে।কারণ, এই বাঁধের সাহায্যে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে জলসেচ করে সেগুলি আবাদি জমিতে পরিণত করা যাবে। আবার এই বাঁধের জলাধার থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা শিল্পোন্নয়নে সাহায্য করবে। এই নির্মাণ প্রকল্পের মােট খরচ ধরা হয়েছিল ১৪০০ মিলিয়ন ডলার। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক মিলিতভাবে এই প্রকল্পের জন্য ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজিও হয়। কিন্তু এক বছর আলােচনা চলার পর আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্ররােচনায় বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে দিলে নাসের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।

(৩) সুয়েজ খাল জাতীয়করণ

ক্ষুব্ধ নাসের ২৬ জুলাই, ১৯৫৬ খ্রি. সুয়েজ খাল এবং‌ সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির জাতীয়করণ করেন। তিনি ঘােষণা করেন যেㅡ

  • [i] এই সুয়েজ খাল থেকে আদায় করা অর্থ আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে খরচ করা হবে।
  • [ii] কোম্পানির বিদেশি অংশীদারদের প্রচলিত বাজারদর অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
  • [iii] আন্তর্জাতিক যােগসূত্র হিসেবে সব দেশের জাহাজ এই জলপথ ব্যবহার করতে পারবে। এর ঠিক তিনমাস পরে (২৯ অক্টোবর, ১৯৫৬ খ্রি.) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের গােপন প্ররােচনায় ইজরায়েল মিশর আক্রমণ করে।

মিশর আক্রমণ

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইজরায়েল মিশর আক্রমণ করে সিনাই উপত্যকা দখল করে। শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নির্দেশে ২২ ডিসেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তারা সৈন্য অপসারণ করে।

সুয়েজ সংকটের গুরুত্ব বা ফলাফল

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুয়েজ সংকটের প্রভাব ছিল গভীর।

(১) নাসেরের মর্যাদা বৃদ্ধি

সুয়েজ সংকটের ঘটনায় শেষপর্যন্ত আরব জাতীয়তাবাদ জয়যুক্ত হয়। নাসেরের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তিনি আরব জগতে বীরের মর্যাদা লাভ করেন।

(২) ইংল্যান্ডের আর্থিক ক্ষতি

মিশরের যুদ্ধে ব্রিটেনের প্রচুর অর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। বিপুল আর্থিক ক্ষতির ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ধস নামে। উইলফ্রিড ন্যাপ মনে করেন যে, মিশরের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রাধান্যের অবসান ঘটায়।

(৩) ইডেনের মর্যাদা হ্রাস

সুয়েজ সংকটের ঘটনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেনের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি যথেষ্ট পরিমাণে নষ্ট হয়। ব্রিটেনকে অহেতুক একটি যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটেনে তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। ফলে তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।

(৪) ফ্রান্সের মর্যাদা হ্রাস

সুয়েজ সংকটের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্সেরও কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এই সূত্রে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যেই ফ্রান্সের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা ধ্বংস হয়।

(৫) মিশর ও ইজরায়েলের শত্রুতা

সুয়েজ সংকটের ফলে মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি জটিলতর হয়ে ওঠে।

(৬) রাশিয়ার সুবিধা

সুয়েজ সংকটের ঘটনায় সোভিয়েত রাশিয়া সবচেয়ে লাভবান হয়। এই সংকটে রাশিয়া মিশরকে সমর্থন করায় আরব দুনিয়ায় রাশিয়ার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

(৭) মধ্যপ্রাচ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত

মধ্যপ্রাচ্যে বুশ প্রভাব প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার উদ্দোগ নিলে মধ্যপ্রাচ্য ঠাণ্ডা লড়াই রাজনীতির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।

সুয়েজ সংকট সমাধানে ভারতের ভূমিকা

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সুয়েজ সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

(১) খাল উন্মুক্ত রাখার প্রয়াস

ভারত সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী একটি দেশ। তাই এই খাল উন্মুক্ত রাখার জন্য ভারত চেষ্টা চালিয়েছিল।

(২) খালে মিশরের সার্বভৌমত্ব

ভারত মনে করত যে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ‘কনস্ট্যান্টিনোপল কনভেনশন’ অনুসারে সুয়েজ খাল মিশরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খালের ওপর মিশরের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েও এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে জাতিপুঞ্জের সনদ অনুসারে খাল সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হয়।

(৩) যোগসূত্রকারীর ভূমিকা

ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণমেনন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই সম্মেলনে মিশরের কোনো প্রতিনিধি যোগদান না দেওয়ায় ভারত দু-পক্ষের মধ্যে যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করে।

(৪) মিশরের ওপর আক্রমণের নিন্দা

ভারত মিশরে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু একে ‘নগ্ন আক্রমণ’ বলে মনে করেন।

(৫) যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকা

মিশরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং বিদেশি সৈন্য অপসারণের বিষয়ে আলোচনায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(৬) শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যোগদান

ভারত জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে মিশরে সেনা পাঠায়।

উপসংহার :- সুয়েজ সংকটের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কর্তৃত্বের অবসানের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল রাশিয়া তা সহজেই দখল করে নেয়।

2 thoughts on “সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা”

Leave a Comment