উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আদিম মানব থেকে প্রাচীন সভ্যতাসমূহ’ থেকে হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বর্ণনা ও হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ কী ছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল ।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা
প্রশ্ন:- হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বর্ণনা ও হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ কী ছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
সূচনা :- হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা এক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মহেনজোদাড়ো, হরপ্পা, চানুহূদড়াে, কালিবঙ্গান, লােথাল প্রভৃতি নগরগুলির প্রাপ্ত ধবংসাবশেষ থেকে এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনার ধারণা পাওয়া যায়।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা -র নগর পরিকল্পনার প্রধান দিকগুলি ছিল –
আঞ্চলিক বিভাজন
হরপ্পা নগরটির দুটি অংশ ছিল একটি পশ্চিমের উঁচু দুর্গাঞ্চল এবং অপরটি পূর্বের নিম্নাঞ্চল। দুর্গ এলাকায় শাসক শ্রেণির লােকেরা বসবাস করত আর নিম্নাঞ্চলে সাধারণ শ্রেণির মানুষ বসবাস করত।
রাস্তা
সরল ও প্রশস্ত রাস্তাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত ছিল। বেশিরভাগ রাস্তা একে অপরকে সমকোণে ছেদ করায় শহরগুলি বর্গাকার ও আয়তাকার ব্লকের রূপ নিয়েছিল। ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া রাস্তাগুলি ছিল চুন, সুরকি, পাথর ও পােড়া ইঁট দিয়ে তৈরি। রাস্তার দুধারে বাঁধানাে ফুটপাতে রাত্রে আলাের জন্য ল্যাম্পপােস্টের ব্যবস্থা ছিল। ফুটপাথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ডাস্টবিনও ছিল।
ঘরবাড়ি
আগুনে পােড়ানাে বা রােদে শােকানাে দুই ধরনের ইট দিয়েই ঘরবাড়ি তৈরি করা হত। দুকামরাবিশিষ্ট ছােটো গৃহ থেকে ত্রিশ কামরাবিশিষ্ট একতলা, দোতলা বা তিনতলা বাড়ির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। প্রতিটি গৃহেই শােবার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর ও শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ বাড়িতে রাস্তার দিকে কোনাে জানলা বা দরজা রাখা হত না।
পয়ঃপ্রণালী
হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। জলনিকাশের জন্য পাথরের ঢাকনা দেওয়া নর্দমা ছিল। নর্দমাগুলি পরিষ্কার করার জন্য ইটের তৈরি ঢাকা ম্যানহােলের ব্যবস্থা ছিল।
ম্নানাগার
মহেনজোদাড়োর দুর্গাঞ্চলে সর্বসাধারণের ব্যবহারযােগ্য এক বিশাল বাঁধানাে স্নানাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট। স্নানাগারটির চারিদিকে রয়েছে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল। ঋতুভেদে জল গরম অথবা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগারটিতে জল সরবরাহ এবং পয়ঃপ্রণালীর দ্বারা এখানকার ময়লা জল বের করার ব্যবস্থা ছিল।
শস্যাগার
হরপ্পা ও মহেনজোদাড়ো দুই নগরে দুটি বিশাল আকারের শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে।
নির্মাণশৈলী
হরপ্পার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা সবকিছুতেই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ, যা আধুনিক নগরের সঙ্গে তুলনীয়।
পৌরব্যবস্থা
নগরগুলিতে কেন্দ্রীভূত পৌরব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। নগরগুলির দেখাশােনার দায়িত্ব পালন করত পৌর প্রতিষ্ঠান। পৌর শাসনব্যবস্থার মান ছিল উন্নত।
উপসংহার :- সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আধুনিক যুগের মতােই উন্নত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। সুষ্ঠু নাগরিক পরিকল্পনা নগরবাসীকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা উপহার দিয়েছিল। প্রাচীন যুগের এমন উন্নত নগর পরিকল্পনা সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নজির।
হরপ্পার সভ্যতার পতনের কারণসমূহ
হরপ্পার সভ্যতার পতনের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণকে হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করেছেন।
ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন
ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম তে থাকলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমির সূচনা ঘটে। ভূস্তরের নীচের জল ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে পড়ে এবং কৃষি-উৎপাদন অত্যন্ত কমে যায়।
ভূমিকম্প
হরপ্পা সভ্যতায় খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত সৎকারের নমুনা না থাকা ক্ষতবিক্ষত নরকঙ্কালগুলি থেকে ধারণা করা হয় যে, ভূমিকম্পের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটে।
বন্যা
অনেকের মতে বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ ঘটিয়েছিল। সিল্ধুবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করত। এর ফলে সিন্ধু নদের জল অবরুদ্ধ হয়ে পলি জমে এবং প্রতি বর্ষাতেই প্লাবন দেখা যায়। এম. আর. সাহানির মতে, প্লাবন সিন্ধু সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দেয়।
সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন
সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মহেনজোদাড়োর বাণিজ্যিক গুরুত্ব নষ্ট হয়। পাশাপাশি তীব্র জলাভাবে এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
রক্ষণশীলতা
হরপ্পা ও মহেনজোদাড়োর ক্রমিক অবক্ষয়ের আর-একটি কারণ ছিল স্থবিরতা। জীবনযাত্রার কোনাে ক্ষেত্রেই উন্নত রীতির প্রয়ােগ ঘটাতে নাগরিকরা আগ্রহী ছিল না। এই রক্ষণশীল মনােভাব তাদের জনজীবনকে পঙ্গু করে তুলেছিল।
বনাঞ্চল ধ্বংস
সিন্ধুবাসী গৃহ নির্মাণের প্রয়ােজনীয় ইট পােড়ানাের জন্য যথেচ্ছভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্রুত কমে যায়।
অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হিসেবে অধিকাংশ পণ্ডিত সংঘাত ও রক্তপাতকে নির্দিষ্ট করেছেন। তবে এই সংঘাত ও রক্তপাত কেন ঘটেছিল সে-বিষয়ে দ্বিমত আছে। কারও মতে, অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ থেকেই এই রক্তপাত ঘটেছে।
অভিনিস্ক্রমণ
কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি কারণে সিন্ধুর অধিবাসীরা একসময় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে।
বহিরাক্রমণ
অনেকের ধারণা বহিরাগত শত্রুর আক্রমণকে, প্রধানত বৈদিক আর্যদের আক্রমণকে হরপ্পার পতনের জন্য দায়ী করেছেন। বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে পুরন্দর বা নগর ধ্বংসকারী উপাধি প্রদান আর্যদের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের যুক্তিটিকে আরও জোরালো করেছে।
সাম্প্রতিক গবেষণা
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হল তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। অধুনা উপগ্রহের মাধ্যমে ভূত্বকের ছবি তুলে এই সভ্যতার বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চলছে।
(FAQ) হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
১. সিন্ধু সভ্যতাকে নগর সভ্যতা বলা হয় কেন ?
সিন্ধু সভ্যতার বেশিরভাগ কেন্দ্রেই আধুনিক নগর পরিকল্পনা, উন্নত নাগরিক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে সিন্ধু সভ্যতাকে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা বলে অভিহিত করা হয়।
২. সিন্ধু সভ্যতা কোন নদীর তীরে অবস্থিত ?
সিন্ধু।
৩. সিন্ধু সভ্যতা কারা আবিষ্কার করেন ?
দয়ারাম সাহানি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
৪. হরপ্পা কথার অর্থ কী ?
পশুপতির খাদ্য।