লোককথা কী বা লোকগাথা বলতে কি বোঝ? লোককথার কয়েককটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লেখ? লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
লোককথা কী বা লোকগাথা বলতে কি বোঝ? লোককথার কয়েককটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লেখ? লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে পার্থক্য দেখাও
প্রশ্ন:- লোককথা কী বা লোকগাথা বলতে কি বোঝ? লোককথার কয়েককটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লেখ? লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
ভূমিকা:- লোককথা হল এক ধরনের কাল্পনিক গল্পকথা। এটি এক ধরনের লৌকিক সাহিত্য যার সাহায্যে প্রাকৃতিক বা আধ্যাত্মিক কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা বা উপলব্ধির চেষ্টা করা হয়। এই কাহিনী গুলি কোনো অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনার অনুকরণে সৃষ্টি হতেই পারে।
লোককথা
কার্ল টমলিনসন ও ক্যারল লিঞ্চ-ব্রাউনের মতে, ‘মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমশ্রণে যেসব গল্পগাথা গড়ে উঠেছে’ তা-ই হল লোককথা বা লোকগাথা। এই লোককথাগুলিতে এমন সব জগতের কথা থাকে যেখানে প্রাকৃতিক আইন কার্যকর হয় না। প্রকৃতপক্ষে যুগ যুগ ধরে লোকমুখে প্রচারিত এই সকল কাহিনি সাধারণ মানুষকে আনন্দিত, বিস্মিত, ভীত, আবার কখনো নব প্রেরণায় উদবুদ্ধও করে।
লোককথার উদাহরণ
১) সাত ভাই চম্পা, ২) আলীবাবা ও চল্লিশ চোর, লখিন্দরের জীবন প্রাপ্তি, টম থাম্ব ও দৈত্য ইত্যাদি।
লোককথার বৈশিষ্ট্য
লোককথার কয়েককটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল –
I. শিশুদের জন্য রসদ
লোককথায় সাধারণত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য রসদ থাকে।
II. অজ্ঞাতনামা লেখক
সাধারণভাবে এগুলির প্রকৃত রচয়িতাদের পরিচয় পাওয়া যায় না।
III. অলিখিত কাহিনি
লোককথার কাহিনিগুলি সাধারণভাবে অলিখিত হয়। বর্তমানে অবশ্য বিভিন্ন গবেষক এগুলি বই আকারে প্রকাশ করছেন।
IV. মানুষের আলোচনা
এই কাহিনিগুলিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের বিষয়গুলি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
V. ধর্মীয় বিষয় গুরুত্বহীন
রুপকের মাধ্যমে দেবদেবী বা অপদেবতার সঙ্গে মানবচরিত্রকে যুক্ত করে লোককাহিনিগুলিকে আকর্ষনীয় করে তোলা হয়। এক্ষেত্রে ধর্মীয় গুরুত্ব নেই বললেই চলে।
VI. মুখ্যচরিত্র মানুষ
লোকগাথার মুখ্যচরিত্রগুলি বেশি সময় হয় সাধারন মানুষ।
VII. অতিপ্রাকৃতিক বিষয়
লোককথার চরিত্রগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তব নয়। মানুষের সঙ্গে অতিপ্রাকৃতিক বিষয় যেমন – দেবদূত, পরি, ডাইনি, পক্ষযুক্ত পশু ইত্যাদিকে যুক্ত করে কাহিনিকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়।
VIII. ব্যক্তিত্ব আরোপ
সমস্ত অতিপ্রাকৃতিক চরিত্রগুলির মধ্যে মানুষের মত ব্যক্তিত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়। তারা মানুষের মত কথা বলে এবং নিজেদের চিন্তার প্রকাশও ঘটায়।
IX. নৈতিক শিক্ষার বার্তা
লোককথাগুলির কেন্দ্রে থাকে নৈতিক শিক্ষার বার্তা। এতে সর্বদাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য কিম্বা কাপুরুষতার পরিবর্তে পৌরুষত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।
X. প্রাকৃতিক আইন অকার্যকরী
লোকগাথাগুলি শ্রোতাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায় যেখানে প্রাকৃতিক আইনগুলি কার্যকরী হয় না।
XI. অনির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র
লোককথার কাহিনিগুলিতে স্থান-কাল-পাত্রের কোন সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘একদা এক দেশে এক রাজা বাস করতেন…’ এভাবেই গল্পগুলি শুরু হয়।
XII. প্রচার ও প্রসারের মাধ্যম
নাবিক, সন্যাসী, চারণকবি, যুদ্ধে পরাজিত বন্দি প্রমুখের মাধ্যমে এই লোকগাথাগুলি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
লোককথার গুরুত্ব
লোককথার কাহিনী গুলি ইতিহাস নির্ভর না হলেও ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। যেমন –
সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয়
লোককথার কাহিনিগুলিতে সমসাময়িক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ের যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ফলে অতীতের সেই সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ঐতিহ্য কেমন ছিল তার একটা আভাস লোককথার কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়।
ঐতিহাসিক ধাঁচের আভাস
ঐতিহাসিক কাহিনী অনুসারে বিভিন্ন লোককথার প্রচলন ঘটতে দেখা যায়। এই সব লোককথার কাহিনী থেকে সমসাময়িক সমাজের ঐতিহাসিক ধাঁচ সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলার চাঁদ সদাগরের কাহিনী থেকে সেই সময় বাংলার বণিকদের দূরদেশে বাণিজ্যিক সফরের কথা উপলব্ধি করা যায়।
মনোরঞ্জন
লোককথার গল্পগুলো অতীতকালের মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে আনন্দদান করেছে। সেই সময় এই কাহিগুলিই ছিল মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম।
শিক্ষাদান
লোকগাথার কাহিনী গুলি মানুষকে জীবনে চলার পথে যথার্থ শিক্ষা দান করে থাকে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন যে, “যদি তোমার সন্তানকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের লোককথার গল্প পড়তে দাও। যদি তাদের আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের আরও বেশি লোককথার গল্প পড়তে দাও।”
লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে পার্থক্য
পৌরাণিক কাহিনি ও লোককথার মধ্যে কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন –
বিষয় | পৌরাণিক কাহিনি / রূপকথা | লোককথা / লোকগাথা |
প্রধান চরিত্র | পৌরাণিক কাহিনীতে প্রধান চরিত্রগুলি অলৌকিক জগতের। ঈশ্বরই মূল নায়ক-নায়িকা। | লোককথায় মুখ্য চরিত্রগুলো সাধারণভাবে হয় মানুষ। |
ভিত্তি | এই কাহিনিগুলি সাধারণত ধর্মভিত্তিক হয়। | লোকগাথায় ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায় না। |
কালপঞ্জী | পৌরাণিক কাহিনিগুলির একটি নিজস্ব কালপঞ্জি থাকে। | লোককথার গল্পের স্থান-কাল-পাত্রের কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকে না। |
সহায়ক উপাদান | পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক উপাদান হিসাবে উপমার ব্যপক ব্যবহার করা হয়। | লোককথার কাহিনিকে আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য রূপকের মাধ্যমে দেবদেবী অথবা অপদেবতার সাথে মানব চরিত্রকে যুক্ত করা হয়। |
বিশ্বজনীনতা | জে এফ বিয়ারলেইন দেখিয়েছেন যে, পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে একধরণের বিশ্বজনীনতা আছে। যেমন, বিশ্বের প্রায় সব জনগোষ্ঠির পৌরানিক কাহিনীতে বন্যায় পৃথিবী ডুবে যাওয়া এবং একটি নৌকায় বিভিন্ন প্রজাতির একজোড়া করে পশু এবং একজোড়া মানুষ রক্ষা পাওয়ার কথা আছে। | এই ধরণের বিশ্বজনীনতা লোককথায় নেই। তবে নাবিক, যোদ্ধা, চারণকবি বা ক্রীতদাসদের মাধ্যমে এগুলির দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ার কথা জানা যায়। |
ব্যক্তিত্ব আরোপ | পৌরাণিক কাহিনিতে পশুপাখি ও কীট-পতঙ্গের মধ্যে মানুষের মত ব্যক্তিত্ব আরোপিত হতে দেখা যায় না। | লোককথায় প্রায়শই পশুপাখি ও কীট-পতঙ্গের মধ্যে ব্যক্তিত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়। |
ইতিহাসের উপাদান | ইতিহাসের উপাদান এখানে অপেক্ষাকৃত বেশি পাওয়া যায়। | ইতিহাসের উপাদান এখানে অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। |
উপসংহার :- লোককথার গল্পগুলোর অধিকাংশই সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এই সব কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে না। তাই এরূপ আজব কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইতিহাস ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।