উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়- ঔপনিবেশিক ভারতের শাসন হতে মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) সমালোচনামূলক আলোচনা করা হল।
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন (১৯১৯)
প্রশ্ন:- মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) সমালোচনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকা :- ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর প্রায় এক দশক ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন প্রবর্তন করে।
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) পটভূমি
বিভিন্ন বিষয় এই আইন সংস্কারের পটভূমি তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন –
(ক) সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর সময় ভারতের ভিতরে ও বাইরে ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বিপ্লবীরা লিপ্ত ছিলেন। এমনকি তারা সমগ্র ভারতে এক অখণ্ড ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
(খ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয়দের অর্থ ও লোকবল উভয়েরই প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবি প্রত্যাহার করা তাদের কাছে বাঞ্ছনীয় ছিল না।
(গ) লক্ষ্মৌ চুক্তি
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্মত হয় এবং লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদন করে। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।
(ঘ) হোমরুল আন্দোলন
এই সময় বালগঙ্গাধর তিলক ও শ্রীমতি অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে হোমরুল আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
(ঙ) স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠা
হোমরুল আন্দোলন -এর প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ফলে ভারত সচিব মন্টেগু ঘোষনা করেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।
(চ) নরমপন্থী-চরমপন্থী ঐক্য
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। ফলে কংগ্রেস শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) শর্তাবলী (বৈশিষ্ট্য)
এই আইন অনুযায়ী ভারতে শাসন বিষয়ক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন –
(ক) কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা নির্ধারণ
এই আইনের মাধ্যমে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয় গুলি ছিল —
(i) ক্ষমতা বণ্টন
কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে ক্ষমতা ও আয় বণ্টন করা হয়।
(ii) কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
দেশরক্ষা, রেলব্যবস্থা, পররাষ্ট্র বিভাগ, মুদ্রাব্যবস্থা, আয়কর নীতি, শুল্ক নীতি, পরিবহন ও ডাকবিভাগ প্রভৃতি সর্বভারতীয় বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পণ করা হয় ।
(iii) প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেচ, জল বিদ্যুৎ, রাজস্ব, বনবিভাগ, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতির দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের ওপর ন্যস্ত হয় ।
(খ) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ
এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ বা বড়লাটের শাসন পরিষদ গঠিত হয়। এর গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলি হল —
(i) গঠন কাঠামো
সাত জন সদস্য নিয়ে গঠিত এই পরিষদে অন্তত তিন জন সদস্য ছিল ভারতীয়।
(ii) শাসন পরিচালনা
বড়লাট এই পরিষদের সাহায্যে নিজ দায়িত্বে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তিনি তার কাজের জন্য ভারত সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন, ভারতীয় আইনসভার কাছে নয়।
(গ) কেন্দ্রীয় আইনসভা
এই সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠিত হয়। এর বিশেষ দিকগুলি হল –
(i) আইন প্রণয়ন
সারা ভারতের জন্য আইন প্রণয়ন করার অধিকারী ছিল এই সভা।
(ii) বড়লাটের ক্ষমতা
গভর্নর জেনারেল কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক গৃহীত বিল আইনে পরিণত করতে কিংবা নাকচ করতে পারতেন। এছাড়াও তিনি নিজে অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।
(iii) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
কেন্দ্রীয় আইনসভা দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত হয় । ৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় উচ্চকক্ষ, যার নাম রাষ্ট্রীয় পরিষদ। ১৪০ জন (পরে ১৪৫ জন) সদস্য নিয়ে গঠিত হয় নিম্নকক্ষ বা কেন্দ্রীয় আইনসভা।
(iv) সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের নীতি যথারীতি অক্ষুন্ন থাকে।
(v) সীমাবদ্ধ ভোটাধিকার
মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে ভোটাধিকার দিয়ে ভারতের ভোটাধিকারের মাত্রা সীমাবদ্ধ করা হয়।
(ঘ) প্রাদেশিক দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা
এই আইনের মাধ্যমে প্রদেশে দ্বৈত শাসন প্রবর্তিত হয়। এর বিশেষ দিকগুলি হল –
(i) এককক্ষীয় আইনসভা
শতকরা ৭০ জন সদস্য নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন করা হয়।
(ii) দায়িত্ব বিভাজন
প্রাদেশিক সরকারের সব দায়িত্ব সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত বিষয়ে ভাগ করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা, অর্থ, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার, শ্রম প্রভৃতি সংরক্ষিত বিষয়গুলির দায়িত্ব থাকে প্রাদেশিক গভর্নর ও তার কার্যনির্বাহক সভার ওপর। প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে থাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পূর্ত, আবগারি, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়গুলি।
(iii) আইন বাতিলের অধিকার
হস্তান্তরিত বিষয়ে কোনো আইন পাস করলেও গভর্নর বা গভর্নর জেনারেল তা বাতিল করে দিতে পারতেন।
(ঙ) ভারত সচিবের কাউন্সিল
এই আইনের দ্বারা ৮ থেকে ১২ জন সদস্য নিয়ে ভারত সচিবের কাউন্সিল গঠিত হয়। ভারতে অন্তত ১০ বছর বসবাস বা চাকরিরত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এই কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্য নিযুক্ত হতেন।
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) ত্রুটি
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের বেশ কয়েকটি ত্রুটি ছিল। যেমন –
(ক) বড়লাটের চূড়ান্ত ক্ষমতা
এই সংস্কার আইনে বড়লাট ও তার কার্যনির্বাহী সভার হাতে সব ক্ষমতা বণ্টিত থাকে এবং বড়লাট আইনসভার যে কোনো প্রস্তাব নাকচ করে দিতে পারতেন। অর্থাৎ বড়লাট চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হন।
(খ) দায়িত্বশীলতার অভাব
এই আইনের ফলে ভারতের বড়লাট তার কাজের জন্য কারোর কাছে দায়ী ছিলেন না। এর ফলে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
(গ) ভোটাধিকার সংকুচিত
এই আইনের দ্বারা ভারতের খুব কম সংখ্যক ধনী মানুষ ভোটাধিকার পায়।
(ঘ) সাম্প্রদায়িকতাকে তোষণ
এই আইনের মাধ্যমে শিখ, খ্রিস্টান, মুসলিম ও বর্ণহিন্দুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে ভারতে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আরো বৃদ্ধি পায়।
(ঙ) আইনসভার ক্ষমতাহীনতা
কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল এবং প্রদেশে গভর্নরের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আইনসভা কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের (১৯১৯) গুরুত্ব
বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এই আইনের গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। এর গুরুত্বের দিক গুলি হল –
(ক) রাজনৈতিক শিক্ষালাভ
এই আইনের প্রভাবে ভারতীয়রা প্রথম আইন সভাতে প্রবেশের অধিকার পায়। ফলে তারা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়।
(খ) ভোটাধিকার সম্প্রসারণ
এই আইনের প্রভাবে ভারতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন শুরু হয় এবং ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ ঘটে।
(গ) দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার সূচনা
এই আইনে মন্ত্রীসভাকে তার কাজের জন্য আইন সভার কাছে দায়ী রাখার ব্যবস্থা করা হলে ভারতে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়।
(ঘ) মন্ত্রীসভার ভারতীয়করণ
প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ভারতীয়দের স্থান দিয়ে ব্রিটিশ সরকার শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়করণের পথ প্রস্তুত করে।
উপসংহার :- জাতীয় কংগ্রেস মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারে সন্তুষ্ট হতে পারে নি এবং এই আইনকে তুচ্ছ, বিরক্তিকর এবং নৈরাশ্য জনক বলে অভিহিত করে । শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত একে ‘দাসত্বের এক নতুন অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন