নবম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় ঊনবিংশ শতকের ইউরোপ-রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন উত্তর। CLASS 9 HISTORY CHAPTER 3 Analytical (MARKS-4) Question Answer in Bengali.
নবম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় থেকে বড় (বিশ্লেষণধর্মী) প্রশ্ন উত্তর
Class | NINE |
Chapter | 3 |
Question Type | বিশ্লেষণধর্মী |
Marks | 4 |
প্রশ্ন-1: ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতি গুলি আলোচনা কর।
উত্তর:- ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লবের পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ইউরোপের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে তিনটি নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতিগুলি হল – ন্যায্য অধিকার নীতি, ক্ষতিপূরণ নীতি এবং শক্তিসাম্য নীতি ।
ন্যায্য অধিকার নীতি
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নেতারা ন্যাযা অধিকার নীতির দ্বারা ইউরোপে বিপ্লব-পূর্ববর্তী রাজবংশগুলিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্ৰহণ করেন। এর ফলে ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশ; স্পেন, নেপলস ও সিসিলিতে বুরবোঁ বংশের শাখা; হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ; স্যাভয়, জেনোয়া, সার্ডিনিয়া ও পিডমন্টে স্যাভয় বংশ; মধ্য ইতালিতে পোপ ক্ষমতা লাভ করেন।
ক্ষতিপূরণ নীতি
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেন প্রভৃতি দেশের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ নীতির মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ভূখণ্ড নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
শক্তিসাম্য নীতি
ভবিষ্যতে ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি নষ্ট করতে না পারে এবং বিজয়ী শক্তিগুলির মধ্যে কেউ যাতে খুব বেশি শক্তিশালী হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে ভিয়েনা সম্মেলনে শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “ভিয়েনা সম্মেলনে বিজয়ী শক্তিগুলি প্রথমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং পরে সম্মেলনের তিনটি নীতি প্রয়োগ করে।”
প্রশ্ন:- মেটারনিখ পদ্ধতি’ বা মেটারনিখ ব্যবস্থা’ সম্পর্কে কি জান?
ভূমিকা :- অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ক্লেমেন্স মেটারনিখ ছিলেন সমকালীন ইউরোপীয় রাজনীতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তিনিই ছিলেন প্রধান নিয়ন্ত্রক। তাই ঐতিহাসিক ফিশার এই সময়কালকে ‘মেটারনিখের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।
রক্ষণশীল পদক্ষেপ
মেটারনিখ যতদিন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ততদিন অস্ট্রিয়ায় এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভিয়েনা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের দ্বারা ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিভিন্ন তীব্র রক্ষণশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
রক্ষণশীল পদক্ষেপের উদ্দেশ্য
তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল –
- (ক) ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা।
- (খ) ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত উদারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র প্রভৃতি প্রগতিশীল ভাবধারার অগ্রগতি রোধ করা।
- (গ) অস্ট্রিয়ার স্বার্থসিদ্ধি করা এবং ইউরোপে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বজায় রাখা।
উপসংহার :- উপরোক্ত নীতিগুলি বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে মেটারনিখ অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপে যে দমনমূলক নীতি চালু করেন তা ‘মেটারনিখ পদ্ধতি’ বা ‘মেটারনিখ ব্যবস্থা’ বা ‘মেটারনিখ সিস্টেম’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন:- মেটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ কর।
ভূমিকা :- অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁর রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে যে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন তা মেটারনিখ ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
(ক) পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
মধ্যযুগীয় অভিজাততন্ত্র, ঐশ্বরিক ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, ক্যাথোলিক গির্জার প্রাধান্য প্রভৃতি পুরোনো ভাবধারাগুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মেটারনিখ আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যান।
(খ) বিপ্লব-বিরোধিতা
মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লব এবং বিপ্লব-প্রসূত আধুনিক ভাবধারা – উদারতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র প্রভৃতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি এই সব আধুনিক ভাবধারাকে রাজনৈতিক মহামারি বলে মনে করতেন।
(গ) পরিবর্তনের বিরোধিতা
সব ধরনের পরিবর্তনের বিরোধী মেটারনিখ ইউরোপের রাজাদের পরামর্শ দিতেন, “রাজত্ব করুন, কিন্তু কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার করবেন না।”
(ঘ) অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য রক্ষা
অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে যে-কোনো উপায়ে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য ও নেতৃত্ব বজায় রাখাই ছিল মেটারনিখের মূল উদ্দেশ্য।
উপসংহার :- মেটারনিখ মনে করতেন যে, বিপ্লবী ভাবধারাগুলি হল জীবাণুর মতো, তা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রশ্ন:- জুলাই অর্ডিন্যান্স’ কী?
উত্তর:- ফ্রান্সের সম্রাট দশম চার্লসের প্রধানমন্ত্রী পলিগন্যাক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জুলাই অর্ডিন্যান্স ছিল তারই ফল।
অর্ডিন্যান্স জারি
মন্ত্রী পলিগন্যাকের পরামর্শে রাজা দশম চার্লস আইনসভা ভেঙে দিয়ে নতুনভাবে নির্বাচন করলে সেখানে সরকারবিরোধীরাই জয়ী হয়। এই পরিস্থিতিতে পলিগন্যাকের প্রভাবে দশম চার্লস ২৫ জুলাই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘অর্ডিন্যান্স অব সেন্ট ক্লড’ বা ‘জুলাই অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন। এই
অর্ডিন্যান্সের বিধিসমূহ
জুলাই অর্ডিন্যান্সের দ্বারা নতুন আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, বুর্জোয়াদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে শুধু সম্পাদশালী অভিজাতদের ভোটাধিকার বজায় রাখা হয়, ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের সনদ বাতিল করা হয়।
জুলাই বিপ্লব
প্রতিক্রিয়াশীল জুলাই অর্ডিন্যান্স ঘোষণার পরদিন থেকেই ফ্রান্সে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। থিয়ার্স, লাফায়েত, তালিরঁ, গিজো প্রমুখের নেতৃত্বে আন্দোলন দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়।
উপসংহার :- আন্দোলনের চাপে দশম চার্লস তার নাবালক পৌত্রের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন। কিন্তু বিপ্লবী নেতারা অর্লিয় বংশীয় লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের রাজা বলে ঘোষণা করেন।
প্রশ্ন:- ইতালির ঐক্য আন্দোলনে জোসেফ ম্যাৎসিনির অবদান উল্লেখ করো।
উত্তর:- ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইতালির খণ্ডবিখণ্ড রাজ্যগুলি জয় করে ঐক্যবদ্ধ করলেও তাঁর পতনের পর ভিয়েনা বন্দোবস্তের দ্বারা ইতালিকে একটি ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিণত করা হয়।
ম্যাৎসিনি
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতা ও প্রাণপুরুষ জোসেফ ম্যাৎসিনি।
আদর্শ
ম্যাৎসিনির আদর্শ ছিল বিদেশি শক্তির সহায়তা ছাড়া ইতালিবাসী রক্ত ঝরিয়ে দেশে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে।
কার্বোনারি সমিতিতে যোগদান
ম্যাৎসিনি প্রথম জীবনে কার্বোনারি নামে এক গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়ে ইটালিকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কার্বোনারি আন্দোলনের দুর্বলতা উপলব্ধি করে তিনি এই দল ত্যাগ করেন।
ইয়ং ইতালি দল গঠন
নির্বাসিত অবস্থায় ম্যাৎসিনি ফ্রান্সের মার্সাই শহরে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইয়ং ইটালি’ বা ‘নব্য ইতালি’ নামে যুবদল প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল শীঘ্রই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি ইয়ং ইতালি’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন।
রোম ও টাস্কানিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে ম্যাৎসিনি নির্বাসন ছেড়ে ইটালিতে ফিরে এসে ইয়ং ইতালি দলের সদস্যদের নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে রোম ও টাস্কানিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার :- সংগঠনের অভাব, অস্ট্রিয়া ও ফরাসি শক্তির তীব্র দমননীতির ফলে ম্যাৎসিনির আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বলতে হয় তিনিই ইতালির ঐক্যের বীজ বপন করে যান।
প্রশ্ন:- ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুরের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর:- বিদেশি শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করে খণ্ডবিখণ্ড ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাঁরা অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইতালির পিডমন্টের রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর।
মতাদর্শ
বাস্তববাদী ক্যাভুরের মতাদর্শ ছিল ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করা এবং পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার অধীনে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা।
বিদেশি সাহায্য
বিদেশি শক্তির সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সহায়তা করেন। তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে প্লোমবিয়ের্সের গোপন চুক্তির স্বাক্ষর করেন।
অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
পিডমন্ট ফ্রান্সের সহায়তায় অস্ট্রিয়াকে ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনো-র যুদ্ধে পরাজিত করে লম্বার্ডি দখল করে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি দ্বারা পিডমন্টের সঙ্গে লম্বার্ডি ও মিলান যুক্ত হয়।
উপসংহার :- দেশের জটিল পরিস্থিতিতে শীঘ্রই ক্যাভুর ফ্রান্সের সঙ্গে এক বোঝাপড়া করেন। এর দ্বারা স্থির হয় ফ্রান্স মধ্য ইতালির রাজ্যগুলির সংযুক্তিতে আপত্তি করবে না। ফলে শীঘ্রই গণভোটের মাধ্যমে পিডনন্টের সঙ্গে মধ্য ইটালির রাজগুলি যুক্ত হয়।