মনসবদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো

উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় ‘রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং তার শাসন যন্ত্র’ থেকে মনসবদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো

মনসবদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো

প্রশ্ন:- মনসবদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো ।

ভূমিকা:- আকবর মোগল প্রশাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ভারতে প্রথম মনসবদারি প্রথা চালু করেন। সামরিক-অসামরিক যে-কোনো কর্মচারী মনসবদার হতে পারতেন।

অর্থ

‘মনসব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘পদমর্যাদা’, উচ্চপদ বা অবস্থান। এই অর্থে মনসবদার হলেন প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারী। মোগল যুগে ‘মনসব’ শব্দটি একটি পদকে বোঝাত। ধীরে ধীরে এই পদের সঙ্গে দায়িত্ব, মর্যাদা প্রভৃতি যোগ হয়।

প্রেক্ষাপট

আকবরের আগে পর্যন্ত মোগল প্রশাসনের সামরিক, বেসামরিক সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বেতনের বদলে জায়গির প্রদান করা হত। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থায় নানা দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটলে নতুন এক প্রথা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অপরদিকে যথেষ্ট হারে জায়গির বিতরণ করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ কমে যায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রবর্তিত হয় মনসবদারি প্রথা।

বিভিন্ন স্তর

আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আকবর মনসবদারদের ৬৬টি Rank বা পদমর্যাদার স্তর ধার্য করেন। সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ১০ জন অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি এবং সর্বোচ্চ স্তরে ছিল ১০ হাজার অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি। তবে আবুল ফজলের ধারণায় কাগজে কলমে ৬৬টি স্তর দেখানো হলেও প্রকৃত অর্থে ৩৩টি স্তর ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।

বেতন

মোগল যুগে মনসবদারদের বেতন খুব একটা কম ছিল না। মনসবদারদের যা বেতন দেওয়া হত, সমস্ত খরচ মেটানোর পরেও তাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা অবশিষ্ট থাকত।

জাঠ ও সওয়ার

মনসবদার নামকরণের সঙ্গে জাঠ ও সওয়ার নামে দুটি পদ যুক্ত ছিল। জাঠ হল মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও তার প্রাপ্ত বেতনের পরিচয়। আর সওয়ার হল মনসবদারের অধীনস্থ সেনার পরিচয়। আকবর তাঁর রাজত্বকালের শেষ দিকে (১৫৯৫-৯৬ খ্রি.) জাঠ ও সওয়ার পদ দুটি চালু করেন।

মনসবদারি প্রথার ফলাফল

আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থার ফলাফল ছিল নিম্নরূপ। –

  • (১) আকবর ও তাঁর পরবর্তী সম্রাটরা মনসবদারি প্রথার সাহায্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।
  • (২) মনসবদার পদ এবং এর সঙ্গে যুক্ত জায়গির বংশানুক্রমিক না হওয়ায় মোগল যুগে সামন্তপ্রথার উদ্ভব ঘটে নি।
  • (৩) মনসবদারি প্রথার ফলেই মোগল প্রশাসনে বিদেশি অভিজাত শ্রেণি, যথা‌- উজবেগি, আফগানি, তুরানি, ইরানি, এদের প্রাধান্য খর্ব হয়।
  • (৪) মনসবদারি প্রথার ফলে মোগল রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ত্রুটি

মনসবদারি প্রথা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। এর বিভিন্ন ত্রুটি গুলি হল –

  • (১) মনসবদারি প্রথা ছিল এক জটিল ও অস্থায়ী পদ্ধতি। সময়ের সাথে সাথে এই প্রথার মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়তে থাকে।
  • (২) বেশিরভাগ মনসবদারদের অধীনস্থ সেনারা ছিল অদক্ষ ও অযোগ্য।
  • (৩) বহু ক্ষেত্রে মনসবদারদের অধীনস্থ সেনাদের সঙ্গে সম্রাটের তরফে কোনো যোগসূত্র না থাকায়, তাদের মধ্যে সম্রাট বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রতি কোনো আনুগত্য গড়ে ওঠে নি। এজন্য ঐতিহাসিক উইলিয়াম আরভিন বলেছেন, “মোগল সামরিক ব্যবস্থার মধ্যেই মোগলদের ধ্বংসের বীজ লুকিয়েছিল।”

উপসংহার :- আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথা ছিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত পুরানো একটি প্রথা। আকবরের নিজ দক্ষতা গুণে এই প্রথায় সম্মিলিতভাবে সেনানায়ক, অভিজাতশ্রেণি ও আমলা সম্প্রদায় রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত ছিল।

Leave a Comment