ঠান্ডা লড়াই কী? ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব আলোচনা

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায়: ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ হতে ঠান্ডা লড়াই কী? ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব আলোচনা করা হল।

Table of Contents

ঠান্ডা লড়াই কী? ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব আলোচনা

প্রশ্ন:- ঠান্ডা লড়াই কী? ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব আলোচনা কর।

ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পর পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্র আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি রাষ্ট্রজোট এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্ব রাজনীতি এই দুই শক্তিজোটের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। দুই মহাশক্তিজোটের যুদ্ধ-পরবর্তী এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দ্বি-পাক্ষিক রাজনীতি’ বা ‘দ্বিমেরুকরণ বলা হয়। যুদ্ধের পরবর্তীকালে এই দুই শক্তিজোটের মধ্যে দীর্ঘকাল ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে।

ঠান্ডা লড়াই কী?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের (১৯৪৫ খ্রি.) পরবর্তীকালে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না হলেও দীর্ঘকাল ধরে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যুদ্ধের আবহ বা ছায়াযুদ্ধ চলতে থাকে। প্রকৃত যুদ্ধের সূচনা না হলেও উভয়ের মধ্যে চলতে থাকা এই ছায়াযুদ্ধ বা যুদ্ধের পরিবেশকে ‘ঠান্ডা লড়াই’ বা Cold War নামে অভিহিত করা হয়।

ঠান্ডা লড়াই কথাটির ব্যবহার

মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান (Walter Lippman) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘The Cold War’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘ঠান্ডা লড়াই’ কথাটি ব্যবহার করেন।

ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সংঘটিত ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ —

(১) পরস্পর-বিরোধী জোট

ঠান্ডা লড়াই ছিল আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শক্তিজোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

(২) সহযোগিতা

আমেরিকা ও রাশিয়া তাদের জোটের অন্তর্ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করতে যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়।

(৩) রাজনৈতিক মতাদর্শের লড়াই

ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে আমেরিকা গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও সাম্যবাদের নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে।

(৪) সামরিক শক্তিবৃদ্ধি

প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পক্ষই অস্ত্র তৈরি-সহ সার্বিক সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়।

(৫) ছায়া যুদ্ধ

আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনো পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি। কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল।

ঠান্ডা লড়াই সূচনার প্রেক্ষাপট

ঠান্ডা লড়াইয়ের পিছনে শুধুমাত্র আদর্শগত ভিত্তি বা অর্থনৈতিক ভিত্তি দায়ী ছিল এরকম মনে করা অতি সরলীকরণ হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাও ঠান্ডা যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। এই কারণগুলি হল নিম্নরূপ। –

(১) সাম্প্রতিক বিপ্লবের বিরোধিতা

রাশিয়ার স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি রাশিয়ার সাম্যবাদী সরকারকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে। ফলে পশ্চিমি দেশগুলির প্রতি রাশিয়ার মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়।

(২) হিটলারের প্রতি তোষণ নীতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিটলার জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় ইংল্যান্ডফ্রান্স হিটলারের চেয়ে সাম্যবাদী রাশিয়াকে নিজেদের বড়ো শুত্রু বলে মনে করত। তাই ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতির মাধ্যমে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে হিটলারকে আরও প্ররোচিত করা হয়।

(৩) দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রশ্ন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় জার্মানির হিটলার ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়া নাস্তানাবুদ হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপে একটি দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মিত্র শক্তির সদস্য আমেরিকা ও ইংল্যান্ড দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার বিষয়ে অযথা টালবাহানা করে সময় কাটায়। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের এরূপ আচরণে মিত্রশক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাশিয়ার মনে তৈরি হয়।

(৪) নেতৃত্বের পরিবর্তন

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের মৃত্যু হলে হ্যারি এস. ট্রুম্যান মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এদিকে ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিল পরাজিত হন এবং শ্রমিক দলের নেতা ক্লেমেন্ট এটলি পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পশ্চিমি এই দেশ দুটির নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে পূর্বের সৌহার্দ্য ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। একসময় রাশিয়ায় সহকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ. এফ. কেন্নান এক টেলিগ্রাম বার্তায় জানান যে, সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃবর্গকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তারা কট্টর মার্কসলেনিনপন্থী।

(৫) রুশ সম্প্রসারণ

বলশেভিক বিপ্লবের আগে থেকেই রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করে। রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে পোল্যান্ড, রুমানিয়া প্রভৃতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে রাশিয়ার মিত্র সরকারের প্রতিষ্ঠা চায়। কিন্তু নতুন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান পূর্ব ইউরোপে রুশ সম্প্রসারণ মানতে রাজি ছিলেন না।

(৬) পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে মতভেদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে কীভাবে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হবে তা নিয়ে আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন – এই পাঁচটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। কাউন্সিলের প্রতিটি অধিবেশনেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ এর সঙ্গে অন্য চারটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। যেমন – ট্রিয়েস্ট নিয়ে বিরোধ, ইতালির উপনিবেশ নিয়ে বিরোধ ইত্যাদি।

(৭) জার্মানির ক্ষতিপূরণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য জার্মানিকে অভিযুক্ত করে জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিছুদিন পর জার্মানির কাছ থেকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ক্ষতিপূরণ আদায়ে আপত্তি জানায়। তাই রাশিয়া অভিযোগ করে যে, জার্মান সামরিক শক্তিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই ইশ-মার্কিন পক্ষ জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপুরণ আদায় করতে চাইছে না। এর ফলে পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যথেষ্ট ঠিক হয়।

(৮) আণবিক বোমার গবেষণা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আমেরিকা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে আণবিক বোমা তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমেরিকা গোপনে এই বোমা তৈরি করায় আমেরিকার প্রতি রাশিয়ার সন্দেহ বৃদ্ধি পায়। এরপর জাপান -এর হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা আণবিক বোমা বর্ষণ করলে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়।

এই সমস্ত ঘটনার সম্মিলিত ফলশ্রুতিতে ইউরোপে ঠান্ডা লড়াইয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়।

ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব

ঠান্ডা লড়াই সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিককে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর এর প্রভাব পড়েছিল বেশি।

(১) সামরিক জোট গঠন

ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন -ন্যাটো, ওয়ারশ চুক্তি ইত্যাদি।

(২) অস্ত্ৰ প্ৰতিযোগিতা

ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাটো’ শিবির এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘ওয়ারশ চুক্তি’ শিবির পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করে। দুই পক্ষই প্রচুর পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য মজুবত করে রাখে।

(৩) আন্তর্জাতিক বিরোধ

পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক জোট ও সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে উদ্ভূত ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি সংকট ঘনীভূত হয়। যেমন – কোরিয়া সংকট (১৯৫০ খ্রি.), ভিয়েতনাম সংকট (১৯৫৬-৭২ খ্রি.), সুয়েজ সংকট (১৯৫৬ খ্রি.), কিউবা ক্ষেপনাস্ত্র সংকট (১৯৬২ খ্রি.) প্রভৃতি।

(৪) বার্লিন প্রাচীর ধ্বংস

ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে বার্লিন প্রাচীর তৈরি হয়েছিল। আবার ঠান্ডা লড়াই-ই ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রাচীর ধ্বংসে উদ্যোগ নিয়েছিল।

(৫) সোভিয়েত রাশিয়ার ডাঙন

ঠান্ডা লড়াইয়ে অংশ নিয়ে, দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত অস্ত্রনির্মাণে এবং বিভিন্ন দেশকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে রাশিয়া আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ভেঙে যায়।

(৬) স্বাধীনতা লাভ

ঠান্ডা লড়াই এবং এর ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে কয়েকটি বালটিক রাজ্য এবং পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া সহ বেশ কয়েকটি প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা লাভ করে।

(৭) একমেরুকরণ

ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে আমেরিকা পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ফলে বিশ্বব্যবস্থা একমেরুকরণ হয়ে ওঠে।

(৮) কমিউনিজমের পতন

রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক জোট পশ্চিমি জোটের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছিল তাতে কমিউনিস্ট জোটের পরাজয় ঘটে। ফলে বহু দেশে কমিউনিস্ট প্রভাবের অবসান ঘটতে থাকে ।

 উপসংহার :- ঠান্ডা লড়াই উদ্ভবের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত রাশিয়া কেউ এককভাবে দায়ী ছিল না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ঠান্ডা লড়ায়ের সূচনা ঘটেছিল একথা বলাই যায়।

Leave a Comment