উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সিলেবাস (তৃতীয় অধ্যায়) ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃতিঃ নিয়মিত ও অনিয়মিত সাম্রাজ্য হতে ঔপনিবেশিক ভারতে অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করা হল।
ঔপনিবেশিক ভারতে অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল
প্রশ্ন:- ঔপনিবেশিক ভারতে অব শিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
ভূমিকা :- ভারত -এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের সবথেকে বিস্ময়কর ঘটনা হল ভারতের চিরচারিত ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের ধ্বংস সাধন। ঔপনিবেশিক ভারতে দাদাভাই নৌরজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ বিদগ্ধ ব্যক্তিরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ক্ষতিকর দিকগুলি আলোচনা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম অব শিল্পায়নের কথা তুলে ধরেন।
অব শিল্পায়ন
অব শিল্পায়নের আক্ষরিক অর্থ হল শিল্পের অধোগতি। অষ্টাদশ শতকে ঔপনিবেশিক শক্তির সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক গতিবিধির পরিনামে বাংলা তথা ভারতের প্রচলিত কুটির শিল্প গুলির যে অবক্ষয় ঘটেছিল তাই অব শিল্পায়ন নামে পরিচিত।
অব শিল্পায়নের কারণ
ঔপনিবেশিক ভারতে অব শিল্পায়নের কারণ গুলিকে আমরা নিম্নলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি। –
i) কাঁচামাল রপ্তানি
ব্রিটিশ সরকার তুলো, নীল, চা, রেশম প্রভৃতি কাঁচামাল ভারত থেকে ইংল্যান্ডের কারখানায় পাঠাতে থাকে। ফলে কাঁচামালের অভাবে দেশীয় শিল্পের অবনতি দেখা দেয়।
ii) ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব -এর সূচনা হয়। এর ফলে সেখানকার কারখানা জাত উন্নত মানের সস্তা শিল্পপণ্য ভারত ও বিশ্বের বাজার দখল করে নেয়। ফলে ভারতীয় শিল্পপতি ও বণিকদের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
iii) অসম শুল্ক নীতি
ইংরেজ কোম্পানি ভারতে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু দেশীয় শিল্পজাত পণ্যের ওপর অত্যধিক শুল্ক আরোপ করা হয়। এই অসম শুল্ক নীতির কারণে ভারতীয় শিল্পে অবক্ষয় নেমে আসে।
iv) অবাধ বাণিজ্য
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিকরা ব্যাপক হারে ভারতে আসতে থাকে এবং অবাধ বাণিজ্য শুরু করে। এরপর বিদেশি পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের বাজার প্রতিযোগিতায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে ভারতের বস্ত্রশিল্পের সর্বনাশ ঘটে।
v) নির্যাতন ও বঞ্চনা
ঔপনিবেশিক শাসনে দাদন প্রথা, কমিশন প্রথা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনা দেশীয় শিল্পের যথেষ্ট ক্ষতি করে।
vi) পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির অবসান
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসারের ফলে দেশীয় রাজন্যবর্গ ও রাজকর্মচারীদের পতন ঘটে। এদের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ও ক্রেতার অভাব দেখা দেয়। ফলে দেশীয় শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।
অব শিল্পায়নের ফলাফল
অব শিল্পায়নের ফলে বাংলা তথা ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। অব শিল্পায়নের ফলে –
i) বেকারত্ব বৃদ্ধি
শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের ফলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের মতে শুধুমাত্র বাংলায় বেকারের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ লক্ষ।
ii) কৃষির উপর চাপ বৃদ্ধি
বেকার শিল্পী ও কারিগররা জমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে কৃষির উপর চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
iii) নগরের অবক্ষয়
শিল্প সমৃদ্ধ ঢাকা, সুরাট, মুর্শিদাবাদ, তাঞ্জোর প্রভৃতি ঘনবসতিপূর্ণ শহর গুলি অব শিল্পায়নের ফলে জনবিরল অঞ্চলে পরিণত হয়।
iv) দারিদ্র্য বৃদ্ধি
অব শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হলে ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
v) গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন
অব শিল্পায়নের ফলে ভারতীয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন দেখা যায়। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হয়।
vi) কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ
অব শিল্পায়ন ভারতকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হতে থাকে।
vii) পণ্য আমদানিকারক দেশ
দেশীয় শিল্পের ধ্বংস হলে ভারত পণ্য দ্রব্যের রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। বিলাতের শিল্পজাত পণ্য ভারতের বাজার দখল করে নেয়।
উপসংহার :- অব শিল্পায়নকে বহু সমালোচক অলীক কল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস মনে করেন, অব শিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক অলীক কল্পনা। কিন্তু ড. অমীয় বাগচী, ড. বিপাণ চন্দ্র প্রমুখ মনে করেন অব শিল্পায়ন একটি বাস্তব ঘটনা এবং তা ভারতবাসীকে দুঃখ দুর্দশার তিমিরে নিক্ষেপ করেছিল।