উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সমাজের ঘটনা প্রবাহ’ থেকে মধ্যযুগে ভারতে সুলতান রাজিয়ার কার্যাবলি সম্বন্ধে লেখাে।
মধ্যযুগে ভারতে সুলতান রাজিয়ার কার্যাবলি
প্রশ্ন:- মধ্যযুগে ভারতে সুলতান রাজিয়ার কার্যাবলি সম্বন্ধে লেখাে।
সূচনা :- দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের একমাত্র মহিলা সুলতান ছিলেন রাজিয়া।দাস বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ইলতুৎমিস মৃত্যুর পূর্বে তাঁর কন্যা রাজিয়াকে সুলতান হিসাবে মনোনীত করেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর দিল্লির গোঁড়া উলেমা ও আমির-ওমরাহরা তার পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
রাজিয়ার সিংহাসনে আরোহন
উলেমাও আমির-ওমরাহদের অনুগ্রহে রুকনউদ্দিন ফিরোজ দিল্লির সিংহাসনে বসলেও অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অযোগ্যতা ও অপদার্থতায় আমির-ওমরাহদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তাঁরা রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনচ্যুত করে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজিয়াকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
রাজিয়ার সমস্যা ও তার সমাধান
রাজিয়া সিংহাসনে বসেই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। এগুলি হল রুকনউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী মালিক মহম্মদ জুনাইদি কর্তৃক রাজিয়ার সিংহাসনারােহণের বিরােধিতা। মুলতান, বদাউন, হানসি ও লাহােরের শাসনকর্তাদের দিল্লি অবরােধ এবং এর দ্বারা রাজিয়ার ক্ষমতায় টিকে থাকাকে বিপন্ন করে তােলা। রাজিয়া স্থির মস্তিষ্কে উদ্ভূত সমস্যাগুলির সমাধান করেন। এজন্য তাঁর পদক্ষেপগুলি ছিল বিদ্রোহী আমির ও প্রাদেশিক শাসকদের মধ্যে সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করা। কবির খান, ইজ্জুদ্দিন সালারি প্রমুখকে নিজের গােষ্ঠীতে নিয়ে আসা।
রাজনৈতিক দক্ষতা
সুলতান রাজিয়া শাসন পরিচালনার জন্য একটি নিজস্ব অনুগত গোষ্ঠী গড়ে তােলার উদ্যোগ নেন এবং আমলা ও প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহ দক্ষতার সঙ্গে দমন করেন। তিনি তুর্কি আমির-ওমরাহ ও অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করে দ্রুত একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলেন। রাজিয়া অশ্বারােহণ, অস্ত্র চালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ
রাজিয়া সিংহাসনে বসেই কেন্দ্রীয় শাসনকে সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনিতুর্কি অভিজাতদের নিয়ে গঠিত ‘তুর্কান-ই-চাহেলগান’ বা ‘চল্লিশের চক্র’ ভেঙে দেন। প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চ পদে অ-তুর্কি মুসলমানকে বসিয়ে তুর্কিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। প্রাদেশিক বিদ্রোহী নেতা নিজাম-উল-মুলকজুনাইদিকে হত্যা করে তার বিদ্রোহ দমন করেন।
অভিজাতদের বিরােধিতা
দিল্লির গোঁড়া মৌলবি ও তুর্কি অভিজাত শ্রেণি বিভিন্ন কারণে রাজিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। রাজিয়ার অশ্বারােহণ, অস্ত্র চালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা, পুরুষের পােশাকে রাজসভা ও শাসনকার্য পরিচালনা প্রভৃতি মধ্যযুগীয় গোঁড়া উলেমা ও অভিজাতরা মেনে নিতে পারেনি। রাজিয়া তুর্কি অভিজাতদের ‘বন্দেগান -ই-চাহেলগান বা চল্লিশের চক্র ভেঙে দিলে অভিজাতরা ক্ষুব্ধ হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে অ-তুর্কিদের নিয়ােগও তুর্কি অভিজাতদের যথেষ্ট অসন্তুষ্ট করে। ফলে তারা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়।
আলতুনিয়ার বিদ্রোহ
পাঞ্জাবের ভাতিন্ডার শাসনকর্তা আলতুনিয়া সুলতান রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। রাজিয়া এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাপতি জামালউদ্দিন-ইয়াকুৎ খাঁ-কে সঙ্গে নিয়ে ভাতিন্ডা দুর্গে অভিযান করেন। আলতুনিয়া এই অভিযানে ইয়াকুৎ খাঁ-কে নিহত করেন এবং রাজিয়াকে বন্দি করেন।
পরিণতি
বাহরাম শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজিয়ার বিরােধীরা বিভিন্ন উচ্চপদ গ্রহণ করলেও আলতুনিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কোনাে পদ দেওয়া হয়নি। ফলে এর প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য আলতুনিয়া রাজিয়াকে বিবাহ করেন এবং সেনাদলসহ দিল্লির অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু যুদ্ধে দিল্লির তুর্কি বাহিনীর হাতে আলতুনিয়া ও রাজিয়া উভয়েই ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন।
সুলতান রাজিয়ার পতন
ইলতুতমিস অভিজাত শ্রেণির ওপর নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু তার মৃত্যুর পর অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য অসম্ভব বৃদ্ধি পায় এবং তারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।সুলতানরাজিয়াই সর্বপ্রথম অভিজাতদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি খর্ব করে রাজশক্তিকে সংগঠিত করতে প্রয়াসী হন।ফলে অভিজাতর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেতার পতন ডেকে আনে।
সুলতান রাজিয়ার কৃতিত্ব
ভারতের মুসলমান যুগে রাজিয়াই ছিলেন একমাত্র নারী, যিনি দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করার সুযােগ পেয়েছিলেন। চার বছরের স্বল্প রাজত্বকালের মধ্যেই তিনি তার প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক, উৎসাহী, সুদক্ষ সেনাপতি ও কূটনীতিতে পারদর্শী। রাজিয়া লােকচক্ষুর অন্তরাল থেকে শাসনকার্য পরিচালনার পরিবর্তে প্রকাশ্য রাজদরবারে বসে শাসন করার যে নীতি গ্রহণ করেন তা অভিজাতদের মনঃপূত হয়নি। তা ছাড়া রাজিয়া নিজ মুদ্রায় ‘সুলতানা’-র পরিবর্তে ‘সুলতান’ কথাটি ব্যবহার করেন, যা অভিজাতদের ঈর্ষান্বিত করেছিল। তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপােষকতা করে তার মানসিক উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছিলেন।
উপসংহার:- সুলতান রাজিয়ার রাজত্বকাল স্বল্পস্থায়ী হলেও তার যােগ্যতা ও মহান কীর্তি তাঁকে ভারত ইতিহাসে স্থায়ী আসন দান করেছে। মধ্যযুগের ইতিহাসে একজন নারী হিসেবে তিনি যে শাসনদক্ষতা, যােগ্যতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, সামরিক শৌর্য ও মানবিক অনুভূতির পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই বিরল।