উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সমাজের ঘটনা প্রবাহ’ থেকে ভারতের ইতিহাসে নূরজাহান চক্র কী ও নূরজাহানের অবদান আলোচনা কর।
নূরজাহান চক্র কী ও নূরজাহানের অবদান আলোচনা
প্রশ্ন:- ভারতের ইতিহাসে নূরজাহান চক্র কী ও নূরজাহানের অবদান আলোচনা কর।
নূরজাহান চক্র
জাহাঙ্গীরের অসুস্থতা ও অন্ধ পত্নীপ্রেমের সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান তাঁর নিকটজনদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন, যা ‘নূরজাহান চক্র‘ নামে পরিচিত।
চক্রের সদস্যবৃন্দ
নূরজাহানের নেতৃত্বাধীন এই চক্রের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন তার পিতা মীর্জা গিয়াস বেগ, ভ্রাতা আসফ খাঁ ও ইদমৎ খাঁ, যুবরাজ খুররম (শাহজাহান) প্রমুখ।
চক্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব
জাহাঙ্গীর ক্রমে আমোদ-প্রমোদ, মদ্যপান ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মোগল প্রশাসন ও রাজনীতিতে নূরজাহান চক্রের কর্তৃত্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়।
চক্রের সদস্যদের উচ্চপদ লাভ
নূরজাহান চক্রের সদস্য মীর্জা গিয়াস বেগ এবং আসফ খাঁ ও ইদমৎ খাঁ মোগল দরবারে উচ্চ রাজপদ লাভ করেন। আসফ খাঁ সম্রাটের ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। নূরজাহান (‘Power behind throne) বা ‘সিংহাসনের চালিকা শক্তি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
খুররমের চক্র ত্যাগ
নূরজাহান তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমকে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে শাহরিয়ারকে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা করেন। ফলে ক্ষুব্ধ খুররম এই চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যান।
নূরজাহান চক্রের পতন
অবশেষে নূরজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত ও পিতা জাহাঙ্গীরকে বন্দি করে খুররম দিল্লির সিংহাসনে বসেন। এর ফলে নূরজাহান চক্র ও নুরজাহানের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
নূরজাহানের অবদান
ভূমিকা :- ‘নূরজাহান’ শব্দের অর্থ হল জগতের আলো। পারস্যের মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা ছিলেন নূরজাহান।তার প্রকৃত নাম মেহেরউন্নিসা। ভারতে এসে শেখ মামুদ নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সাহায্যে গিয়াস বেগ আকবরের দরবারে চাকরি পান। সেখানে আকবর পুত্র সেলিম তথা জাহাঙ্গির মেহেরউন্নিসার অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন।
নুরজাহান ও জাহাঙ্গিরের প্রেম
আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম (জাহাঙ্গির) নূরজাহানের প্রেমে একসময় আকুল ছিলেন। আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম সম্রাট হয়ে ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে আলিকুলি বেগকে হত্যা করেন এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহানকে বিবাহ করে তাকে প্রধানা মহিষীর মর্যাদা দেন।
নূরজাহানের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব
অনুপম রূপলাবণ্যের অধিকারিণী ছিল প্রশংসনীয়। পারসিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চেতনা তাঁর চরিত্রে রুচিবোধ ও আভিজাত্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিল। চিত্রশিল্পে তাঁর দক্ষতা ছিল অপূর্ব। তাঁর চরিত্রে মানবিক গুণাবলির বিপুল সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁর হৃদয় ছিল কোমল ও দয়াপ্রবণ। দুর্বল ও অসহায়দের কষ্ট নিবারণের কাজে তাঁর আন্তরিকতা ছিল গভীর।
রাজনৈতিক দক্ষতা
জাহাঙ্গিরের রাজত্বের শেষে নূরজাহান মোগল রাজনীতিতে প্রায় সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জাহাঙ্গির সজ্ঞানে নূরজাহানকে তাঁর প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত সরকারি ফরমানে জাহাঙ্গিরের নামের পাশে নূরজাহান বাদশাবেগম নামটি উল্লিখিত থাকত। এমনকি রাজকীয় স্বর্ণমুদ্রাতেও বাদশা ও বেগম উভয়েরই ছবি খোদিত ছিল। রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং বিচক্ষণ। তিনি যে-কোনো জটিল রাজনৈতিক বিষয় সহজেই সমাধান করতে পারতেন।
রাজনৈতিক সুযােগ গ্রহণ
১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাহাঙ্গিরের অসুস্থতা ও দুর্বলতার সুযােগে নূরজাহান প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর হাতে মােগল প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। তার সহায়তায় পিতা মির্জা গিয়াস বেগ এবং দুই ভ্রাতা আসফ খাঁ ও ইৎমদ খাঁ রাজদরবারে উচ্চপদ লাভ করেন।
নূরজাহান চক্র গঠন
জাহাঙ্গিরের দুর্বলতা ও অসুস্থতার সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন যা ‘নূরজাহান চক্র’ নামে পরিচিত। জাহাঙ্গির ক্রমে ক্রমে আমোদ-প্রমোদে মত্ত হয়ে পড়লে রাজনীতিতে এই চক্রের একাধিপত্য শুরু হয়। নূরজাহানের নেতৃত্বে গঠিত এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পিতা মির্জা গিয়াস বেগ, ভাই আসফ খাঁ ও যুবরাজ খুররম।
চক্রের উদ্যোগ
জাহাঙ্গির ক্রমে আমােদ-প্রমােদ ও মদ্যপানে গা ভাসিয়ে দিলে প্রশাসন ও রাজনীতিতে নূরজাহান চক্রের একাধিপত্য শুরু হয়। নূরজাহান ‘Power behind the throne’ বা ‘সিংহাসনের পশ্চাতের শক্তি’ হিসেবে শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। অবশ্য ইতিহাসবিদ ড. নুরুল হাসান ‘নূরজাহান চক্র-এর বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
চক্রের পরিণতি
নূরজাহান তার প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমকে জাহাঙ্গিরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানাের পরিকল্পনা করেন। ফলে খুররম এই চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যান। অবশেষে নূরজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত করে খুররম দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
পতন
দিল্লির রাজনীতি থেকে সরে যেতে অনাগ্রহী মহাবৎ খাঁও বিদ্রোহী হয়ে জাহাঙ্গিরকে বন্দি করে সংকট সৃষ্টি করেন। এক্ষেত্রেও নূরজাহান অতি দক্ষতার সঙ্গে বিদ্রোহ দমন করে জাহাঙ্গিরকে মুক্ত করেন। এই ঘটনার অল্পদিনের মধ্যে জাহাঙ্গির অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নূরজাহানের পতন ঘটে।
মৃত্যু
নতুন সম্রাট শাজাহানের আমলে হারেমের অন্দরে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। অবশেষে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহানের মৃত্যু হয়।
কৃতিত্ব
ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, জাহাঙ্গিরের আমলে নূরজাহানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সাম্রাজ্যের পক্ষে শুভ হয়নি। তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে খুররম, মহাবৎ খাঁ প্রমুখ বিদ্রোহী হয়েছিলেন। ড. সৈয়দ নুরুল হাসান ‘নূরজাহান চক্র’ তত্ত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই জাহাঙ্গিরের ইচ্ছানুসারে হয়েছিল। নূরজাহানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল জাহাঙ্গিরের মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং শাজাহানের লক্ষ্য ছিল সিংহাসন দখল করা।
উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে শাহজাহান সিংহাসনে বসার পর নূরজাহানের বাকি জীবন গৃহবন্দি অবস্থায় কাটে। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে লাহোরে জাহাঙ্গিরের কবরের পাশেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়। ড. ত্রিপাঠী বলেছেন, নূরজাহান জাহাঙ্গিরের জীবনে কোনো অশুভ শক্তি হিসেবে দেখা দেননি, তিনি ছিলেন তার রক্ষাকারী দেবদূতের মতোই।