উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: রাজনৈতিক বিবর্তন: শাসনকার্য ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা হতে পলিসের বৈশিষ্ট্য ও পতনের কারণ আলোচনা করো।
উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: পলিসের বৈশিষ্ট্য ও পতনের কারণ
প্রশ্ন:- পলিসের বৈশিষ্ট্য ও পতনের কারণ আলোচনা করো।
পলিস শব্দের অর্থ বা পালিস কাকে বলে?
গ্রিক শব্দ Polis অর্থাৎ স্বশাসিত রাষ্ট্রের বাংলা অনুদিত রূপ হল নগররাষ্ট্র। সাধারণভাবে পলিস হল নগর এবং নগরকে ঘিরে গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত এক একটি রাষ্ট্রীয় একক। গ্রিসের ইতিহাসে ধ্রুপদি যুগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতকে এই রাষ্ট্রগুলি পরিণত রূপ লাভ করে। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে পলিস বা নগররাষ্ট্র বলা হয়।
পলিসের বৈশিষ্ট্য
গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
- (১) রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা :– গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এগুলি আয়তনে ও লোক সংখ্যায় ক্ষুদ্র। প্লেটো তাঁর ‘Republic’ গ্রন্থে বলেছেন যে একটি আদর্শ পলিসের লোক সংখ্যা হওয়া উচিত ৫০০০ জন। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে ১০ জন নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস যেমন স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে না, তেমনি ১ লক্ষ নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস সুদক্ষ শাসন পরিচালনা করতে পারবে না।
- (২) রাজার অনুপস্থিতি :- অধিকাংশ পলিসেই রাজতন্ত্র ছিল না। সেগুলি অভিজাততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এই রূপ বিভিন্ন ধরনের হত। তবে স্পার্টার মতো দু-একটি রাষ্ট্র ছিল এর ব্যতিক্রম। স্পার্টায় রাজার অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে রাজা প্রত্যক্ষ শাসন পরিচালনার পরিবর্তে সেনাপতি ও পুরোহিত হিসাবে কাজ করতেন।
- (৩) প্রশাসনে জনগনের অংশগ্রহণ :- গ্রিক পলিসগুলিতে নাগরিকরা শাসন পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত। তবে নাগরিকরাই পলিসের প্রশাসনের কাজে অংশ নিতে পারত, বিদেশি ক্রীতদাস ও মহিলারা নয়।
- (৪) নিজস্ব গ্রাম :- প্রত্যেক নগররাষ্ট্রই শস্যের জন্য নিজস্ব গ্রামের উপর নির্ভরশীল ছিল। ঐতিহাসিক জোনস্ -এর কথায় “অর্থনৈতিক দিক থেকে নগররাষ্ট্র গুলি গ্রামের উপর নির্ভরশীল ছিল।”
- (৫) স্বাতন্ত্র্য :- গ্রিসের প্রতিটি পলিস একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র ছিল। প্রতিটি পলিসের নিজস্ব সরকার সেনাবাহিনী প্রভৃতি থাকত। এমনকি পলিসগুলির পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা ও মানচিত্র ছিল বলেও অনুমান করা হয়।
- (৬) সুরক্ষা :- নগররাষ্ট্রগুলি ছিল দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত এবং নাগরিক জীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য সুবিধাযুক্ত। শহরগুলি ছোটো হলেও এগুলি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজনৈতিক অস্তিতযুক্ত। ঐতিহাসিক ভিক্টর এরেনবার্গ নগর রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র পরিধির দিক বিচার করে একে ‘Narrows of space’ বলে অভিহিত করেছেন।
- (৭) অর্থনৈতিক বৈষম্য :- প্রাচীন গ্রিসের বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। একদিকে করিন্থ ও মিলেটাসের মানুষ শিল্প ও বাণিজ্যের দ্বারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। অন্যদিকে স্পার্টা, এলিস ও আরকাডিয়ার মানুষ কৃষি, যুদ্ধকর ও মন্দিরের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল।
উপসংহার
এছাড়াও নগর রাষ্ট্রগুলিতে দাস প্রথার মতো নেতিবাচক দিকও ছিল। নগর রাষ্ট্রগুলিতে ঐক্যবোধ থাকলেও সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল প্রকট।
পলিসের পতনের কারণ
গ্রিক পলিসগুলি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পারস্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেও ম্যাসিডনের বিরুদ্ধে তা পারেনি, ফলে পলিসগুলির পতন হয়। এই পতনের পিছনে কতকগুলি কারণ ছিল। যেমন –
- i) নৌবাহিনীর দুর্বলতা :- এথেন্স পলিসের নৌবহরের আর্থিক দায়িত্ব যে ১২০০ ধনী পরিবার পালন করত তারা তা থেকে সরে এলে নতুন করে এই পেশায় যুবকরা। নিযুক্ত হত না। ফলে নৌবাহিনীতে দুর্বলতা দেখা দেয়, যা পলিসের পতনের একটি অন্যতম কারণ ছিল।
- ii) সুযোগ্য সেনাপতির অভাব :– এথেন্সের মতো বড়ো পলিসেও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে সেনাপতি তার আর্থিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ফলে পলিসের মধ্যে সুযোগ্য সেনাপতির অভাব ঘটে যা পলিসের পতনকে ডেকে আনে।
- iii) আদর্শ বিসর্জন :- পলিসের মধ্যে আদর্শ বা সর্বজনীন বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ফলে পলিসের পতন এগিয়ে আসে।
- iv) বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা :- গ্রিসে বাণিজ্যিক উন্নতির ফলে পলিসের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যা সংঘর্ষের রূপ নেয়। এই সংঘর্ষ পলিসের পতন ডেকে নিয়ে আসে।
- v) দক্ষ সামরিক বাহিনীর অভাব :- গ্রিসের অধিকাংশ সৈনারা অপেশাদার বা কৃষক হওয়ায় তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইত না। ফলে দক্ষ সামরিক বাহিনীর অভাবে পলিসের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে ওঠে।
- vi) শক্তিশালী ম্যাসিডনের আক্রমণ :- পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ম্যাসিডনের সমান দক্ষতা গ্রিস পলিসগুলি দেখাতে পারেনি, তাই সুদক্ষ ম্যাসিডনের বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করতে না পারায় গ্রিস পলিসগুলির পতন ঘটে।
উপসংহার
সবশেষে বলা যায় গ্রিক জাতির নৈতিক বিপর্যয় পলিসের পতন ঘটায়। নৈতিক পতনে চিরাচরিত সমাজ ও রাজনীতিতে ফাটল ধরে, ন্যায় বিচার, সততা, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতিতে ভাটা পড়ে। সক্রেটিসের মত জ্ঞানী ব্যক্তিকেও প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়, তাই কালের গতিতে পলিসকে আসন্ন বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা ছিল সব দিক থেকেই অসাধ্য।