পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা

উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত হতে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা করা হল। 

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা

প্রশ্ন:- পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা কর।  (২০১৫)

ভূমিকা :- ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধ ভারত -এর ইতিহাসে এক একটি দিক চিহ্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই দুই যুদ্ধের ফলাফলই ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভাগ্য নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। এই দুটি যুদ্ধ জয় ই ছিল ব্রিটেনের কাছে ভারতে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের শুভ লগ্ন। এখানে উভয় যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা করা প্রয়োজন।

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফলের তুলনা

পলাশীর যুদ্ধ -এ বাংলার নবাব ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে ইংরেজ কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়। এরপর থেকেই বাংলার নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল এবং কোম্পানি হয়ে উঠেছিল king maker.

বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির কাছে তিনটি ( বাংলা, অযোধ্যা ও মোঘল) মিলিত শক্তির পরাজয় ঘটলে বাংলার স্বাধীন নবাবির শেষ দীপ টুকুও নিভে যায়। এখন থেকে বাংলার সামগ্রিক ক্ষেত্রেই কোম্পানির সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনা

পলাশীর যুদ্ধের পর মিরজাফর বাংলার নবাব হলেও তার হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না। এই সময় থেকে একদিকে যেমন বাংলার সমস্ত ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়, তেমনি বাংলার নবাব নাম সর্বস্ব নবাবে পরিণত হন।

বক্সারের যুদ্ধে তিন মিলিত শক্তিকে পরাজিত করার ফলে ইংরেজ কোম্পানির একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তেমনি তাদের আধিপত্য বাংলা ছাড়িয়ে অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানির অধিকার লাভ করার ফলে বাংলা তথা ভারতে কোম্পানির অধিকার কায়েম হয়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনা

পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানি বাংলাদেশে অবাধ একচেটিয়া বাণিজ্য শুরু করে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহার, বিনা শুল্কে বাণিজ্য করায় দেশীয় বণিকরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর থেকে কোম্পানি এদেশের অর্থ ও সম্পদ বিনা বাধায় ইংল্যান্ডে চালান করতে শুরু করে। ঐতিহাসিক ব্রুকস অ্যাডাম এই প্রক্রিয়াকে পলাশীর লুণ্ঠন বলেছেন।

বক্সারের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা দেওয়ানি বা বাংলা,বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। এর ফলে তাদের কাছে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার আর কোনো বাধাই থাকল না। বলা হয় এরপর থেকেই কোম্পানি ভারতে শুরু করেছিল তাদের নির্লজ্জ ও নির্মম শোষণ।

শাসন ক্ষেত্রে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনা

পলাশীর যুদ্ধে জিতে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির জয়যাত্রার সূচনা হয়। বক্সারের যুদ্ধে জিতে ইংরেজ কোম্পানি শাসনক্ষেত্রে চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

সাম্রাজ্যের প্রসারে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনা

পলাশীর যুদ্ধে শুধু বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে ইংরেজদের আধিপত্য বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বক্সারের বাংলার নবাবের সাথে অযোধ্যার নবাব এবং দিল্লির বাদশাহও পরাজিত হন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারতে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফলের তুলনা

সামরিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় পলাশীর যুদ্ধ ছিল নিছক একটি অসম খণ্ড যুদ্ধ মাত্র। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে, পলাশীর যুদ্ধের ফলে ভারতে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

বক্সারের যুদ্ধ ছিল প্রকৃত ও চুড়ান্ত ফল-নির্ণয়কারী যুদ্ধ। ঐতিহাসিক স্মিথের মতে, ‘পলাশির যুদ্ধ ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ’।

উপসংহার :- সুতরাং বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারত ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশি ‘যদিও নির্ণায়ক যুদ্ধ, তথাপি কখনই বৃহৎ যুদ্ধরূপে বিবেচিত হতে পারে না’ (Plassey though decisive, can never be considered as a great battle) – ম্যালেসন। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল ‘এক চূড়ান্ত যুদ্ধ’(a decisive battle) – স্মিথ।

Leave a Comment