উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণী, সপ্তম অধ্যায়, ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ থেকে কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের বর্ণনা ও কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হল।
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ( সপ্তম অধ্যায়) কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের বর্ণনা ও কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল
প্রশ্ন:- কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের বর্ণনা দাও।
অথবা, কোরিয়া সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর:- ভূমিকা:- ১৯৪৫ সালে কোরিয়াবাসীর অনুমতি ছাড়াই কোরিয়াকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয় কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধ।
কোরিয়া সংকটের সূত্রপাত
১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত কোরিয়া জাপানের কর্তৃত্বাধীন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন সেনা ও সোভিয়েত লালফৌজ জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করে। অবশেষে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ার উত্তরাংশে রাশিয়ার ও দক্ষিণাংশে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কোরিয়া সমস্যা সমাধানে কমিশন গঠন
আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করলে সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ সভা একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Commission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই কমিশনের ওপর কোরিয়া থেকে বিদেশি সেনা অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকার গঠন
রাষ্ট্রসংঘের অস্থায়ী কমিশনের সদস্যদের রাশিয়া উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেয় নি। রাষ্ট্রসংঘ নিজ তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি নির্বাচনের আয়োজন করে (১০ মে, ১৯৪৮ খ্রি.)। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ১৫ আগস্ট প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া নামে সেখানে মার্কিন-প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সিওল হয় এর রাজধানী। মার্কিন মদতপুষ্ট সিংম্যান রি ছিলেন এই সরকারের প্রধান।
উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন
এই পরিস্থিতিতে কোরিয়া সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলেন উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সুঙ। সোভিয়েত মদতে তিনি সেখানে গণতান্ত্রিক কোরিয়া নামে একটি সরকার গঠন করেন। পিয়ং ইয়ং হয় এর রাজধানী। এই সরকারের সেনাবাহিনী কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবেশ করলে দু-পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই।
আন্তর্জাতিক সেনা প্রেরণ
নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে এবং কোরিয়ায় রাষ্ট্রসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
চিনের অংশগ্রহণ
রাষ্ট্রসংঘ প্রেরিত বাহিনীর প্রধান জে. ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শত্রুসেনা বিতাড়িত করার পর ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ায় ইয়ালু নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে বোমাবর্ষণ করলে চিন তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরপরই চিন কোরিয়া যুদ্ধে যোগদান করে এবং অতি দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নেয় (৪ জানুয়ারি, ১৯৫১ খ্রি.)।
যুদ্ধের অবসান
শেষপর্যন্ত ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং-এ উভয়পক্ষের যুদ্ধবিরতি ঘটে। পূর্বের মতো ৩৮° অক্ষরেখা ধরেই দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।
কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। যেমন –
(ক) বিভাজন স্বীকার
বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সংযুক্তি তো দূরের কথা, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয়।
(খ) মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি
যুদ্ধে দুই কোরিয়ারই প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। মার্কিনি, কোরীয়, চিনা সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
(গ) আমেরিকার সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রস্তুতি
যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে- র পর তার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়।
(ঘ) ঠান্ডা লড়াইয়ের বিস্তার
এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।
কোরিয়া সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা
জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত সরকার কোরিয়া সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হয়।
(ক) যুদ্ধবিরতি ঘোষণায়
দুই কোরিয়ার মধ্যে সমস্যার সমাধানে জাতিপুঞ্জ সৃষ্ট অস্থায়ী কমিশনের সভাপতি ছিলেন, বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে.পি.এস. মেনন। প্রতিবেদনে মেনন বৃহৎ শক্তিববর্গকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যা মিটিয়ে নেবার আহবান জানান। ভারতের অদম্য প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল।
(খ) যুদ্ধবন্দি সমস্যায়
যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দি সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতের জেনারেল থিমাইয়ার সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যাবাসন কমিশন’। নিরপেক্ষ রাষ্ট্রজোটের এই কমিশনের ঘোষণায় যুদ্ধবন্দি সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা হয়।
(গ) শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতায়
দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে ভারতও উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে। ভারতের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের কর্মসূচি থেকে উভয়পক্ষকে সরিয়ে শান্তির পথে নিয়ে আসা। এই প্রতিবাদে শান্তির প্রতি ভারতের দায়বদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়।
(ঘ) জোটনিরপেক্ষতার সুদৃঢ়করণে
ভারত যে জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী তা কোরিয়ার যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা থেকে পরিস্ফুট হয়। ভারতের জোটনিরপেক্ষতার মধ্যে যে কোনো খাদ নেই, তা বোঝা যায় যখন নেহরু সরকার প্রথমে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে ঘোষণা করে এবং পরে মার্কিন নীতির সমালোচনা করে।
উপসংহার:- কোরিয়ার যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল অনাবশ্যক ও নিষ্ফল, কেন-না দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল শূন্য।
আরোও পড়ুন
বহুবৈকল্পিক প্রশ্ন উত্তর
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর
- ঠান্ডা লড়াই কী? ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব আলোচনা কর।
- হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
- ট্রুম্যান নীতি কী? মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কী ছিল?
- ১৯৫০ দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কমিউনিস্ট চীনের প্রভাব আলোচনা কর।
- সুয়েজ সংকটের কারণ, তাৎপর্য ও এই সংকটে ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর।
- ঠাণ্ডা লড়াই বলতে কী বোঝো? ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি আলোচনা কর।
- জোট নিরপেক্ষ নীতি কী? জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য আলোচনা কর।
- পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতীকরণের উদ্দেশ্য কী ছিল? বিভিন্ন দেশে এর কী প্রভাব পড়েছিল?
- কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের বর্ণনা দাও।